জালটাকা, অস্ত্র ও মাদক মামলায় ১৫ দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে নরসিংদী যুব মহিলা লীগের সদ্য বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন চৌধুরীকে।
পাপিয়া থেকে তথ্য বের করে কাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এত বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে উঠেছেন তিনি তা নিয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছে তদন্ত কর্মকর্তরা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পাপিয়ার পাপকাণ্ডের বিস্তৃত রাজ্যের অনেকটা জুড়েই রয়েছে রাজধানী ঢাকার গুলশানের হোটেল ওয়েস্টিন।
পাপিয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওয়েস্টিন কর্তৃপক্ষের অন্তত পাঁচটি পাপ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং গোয়েন্দা সংস্থার কাছে ধরা পড়েছে।
ওয়েস্টিনে পাপিয়া ১২৯ দিন ছিলেন। গত বছরের ১৩ অক্টোবর পাপিয়া প্রথম ওয়েস্টিনে সাধারণ চারটি রুম বুক করেন। ওই চারটি রুমের একটিতে ছিলেন পাপিয়া, একটিতে তার স্বামী সুমন এবং বাকি দুটিতে ছিল তার বডিগার্ডসহ কেএমজির ক্যাডাররা।
১৫ অক্টোবরে পর প্রেসিডেনশিয়াল রুমে চলে যান। ওই রুমগুলোতে থাকা বাবদ ওই সময়ে পাপিয়া প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা ওয়েস্টিনকে ক্যাশ পরিশোধ করেছেন।
এছাড়া ওয়েস্টিনের বার এবং সুইমিং পুল ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করেছেন পাপিয়া।
প্রতিদিনই রাত ১ টার পর হোটেল ওয়েস্টিনের ২৩ তলার বারে নাচের আসর জামাতেন পাপিয়া। সেখানে মদ্য পানের সঙ্গে উদ্যাম নৃত্য এবং নানারকম অপকর্মে মত্ত থাকতেন পাপিয়ার অতিথিরা।
ওই ১২৯ দিনে এসব সার্ভিস প্রদানের কারণে ওয়েস্টিনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারীদের পাপিয়া প্রতিদিন আট থেকে দশ হাজার টাকা টিপস বা বকশিস হিসেবে দিতেন।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, প্রথমত, ১২৯ দিনে পাপিয়ার সেই স্বর্গরাজ্যের অবস্থান করেছে তার কোনো নথি, তথ্য-উপাত্ত ওয়েস্টিন কর্তৃপক্ষ সংগ্রহ করেনি। ওই সাড়ে চার মাসে পাপিয়ার স্যূটে যেসব ‘এসকট’ অবাধে যাতায়াত করত তাদের নাম-পরিচয় উল্লেখ নেই ওয়েস্টিনের খাতায়।
এছাড়া পাপিয়ার আমন্ত্রণে তার প্রেসিডেনশিয়াল স্যূটে যেসব প্রভাবশালী ব্যক্তি আসতেন তাদের নথিও রাখেনি ওয়েস্টিন। একটা পাঁচ তারকা হোটেলের জন্য এ বিষয়টি একটি গর্হিত অপরাধ।
দ্বিতীয়ত, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর থেকে পাওয়া লাইসেন্স অনুযায়ী, রাত ১২ টার পর বার খোলা থাকবে না। এই সময়ে বার খোলা রাখা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এছাড়া শুক্রবার এবং ধর্মীয় দিনগুলোতে বার বন্ধ রাখতে নির্দেশনা রয়েছে। অথচ ওয়েস্টিন কর্তৃপক্ষ পাপিয়ার জন্য এসব বিধি-নিষেধের তোয়াক্কাই করেনি। সেখানে তার জন্য রাত একটা থেকেই বার চালু করা হতো। এরপর আমন্ত্রিত অতিথিদের জমতো পাপিয়ার আসর।
তৃতীয়ত, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের নিয়ম অনুযায়ী, যে কোনো বারে কোনো বাংলাদেশি মদ পানে গেলে তার সঙ্গে মাদকদ্রব্য গ্রহণের লাইসেন্স থাকতে হবে।
কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গেছে , ওয়েস্টিন কর্তৃপক্ষ এই নিয়মটিও অনুসরণ করেনি।
চতুর্থত, ওয়েস্টিনের সেই রঙ্গমহলে শুধুমাত্র মদই নয়, গাঁজা, চরস-ইয়াবাসহ নানারকম অবৈধ মাদক নিয়ে আসতেন পাপিয়া। অথচ পাঁচ তারকা হোটেলে এ ধরনের অনোনুমোদিত মাদক নিয়ে আসা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু ওয়েস্টিন কর্তৃপক্ষ টাকার বিনিময়ে পাপিয়াকে এ ধরনের মাদক সেবনে স্বাধীনতা দিয়েছে।
পঞ্চমত, ওয়েস্টিনে ১২৯ দিন অবস্থানের সময় পাপিয়া ও তার স্বামী সুমনের সঙ্গে অবৈধ অস্ত্র থাকত। পাপিয়ার বডিগার্ডদের কেউ কেউ অস্ত্র নিয়ে ওয়েস্টিনে প্রবেশ করত। অথচ নিয়মানুযায়ী অস্ত্র নিয়ে পাঁচ তারকা হোটেলে প্রবেশ করা সম্পূর্ন নিষিদ্ধ। এটা ওয়েস্টিনের মতো একটা হোটেলে কিভাবে পাপিয়াকে অস্ত্র নিয়ে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে তা একটা বিষ্ময়।
সচেতনদের প্রশ্ন, ১২৯ দিন অবস্থানের জন্য হোটেল কর্তৃপক্ষকে নগদে যে বিপুল পরিমাণ টাকা প্রদান করেছেন পাপিয়া, সে বিষয়ে হোটেল ওয়েস্টিন কিছুই জিজ্ঞাসাবাদ করেনি তাকে। এছাড়া বাড়ি ছেড়ে পাঁচ তারকা হোটেলের প্রেসিডেনশিয়াল স্যুটে পাপিয়ার দীর্ঘদিন রহস্যজনক অবস্থানের ব্যাপারে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে অবহিত করেনি তারা।
শুধুমাত্র ব্যাবসায়িক দিক থেকে লাভবান হতে সমস্ত তথ্য গোপন করে পাপিয়াকে মাদক সম্রাজ্য গড়তে সম্পূর্ণ সহায়তা দিয়েছে ওয়েস্টিন কর্তৃপক্ষ।
তাই পাপিয়ার পাপকাণ্ডে হোটেল ওয়েস্টিনও দায় এড়াতে পারে না বলে মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা।