বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশই এখন কোভিড-১৯ নামক মহামারী রোগটির সঙ্গে লড়াই করছে। আক্রান্ত ও মৃতের তালিকায় মুহূর্তে মুহূর্তে নতুন নতুন সংখ্যা যোগ হচ্ছে।
গত ১১ মার্চ ভাইরাসটিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মহামারী ঘোষণা দেয়ার সময় এই রোগে মৃতের সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ২৯২ জন। মাসখানেকের ব্যবধানে ১৪ এপ্রিল সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ১২ লাখ।
এতে সহজে অনুমান করতে পারি যে, এ ধরনের ছোঁয়াচে রোগ কত দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে, কতটা বিরূপ প্রভাব ফেলতে মানুষের জীবনে।
বিশ্বের আর সব উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশকেও নানা প্রতিকূলতা এবং অপ্রতুল সম্পদের মধ্যে এই মহামারী প্রতিরোধের লড়াই করতে হচ্ছে।
নানান ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা খাতটি এ দুর্যোগে সরাসরি সেবা দিয়ে আসছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে জাতীয় বাজেটে মাত্র ৪.৯২ শতাংশ বরাদ্দ (২০১৯-২০ অর্থবছর), যা কিনা প্রতিবেশী প্রায় সব দেশের চেয়ে কম।
অথচ বৈরী পরিস্থিতির মধ্যে লড়াই করেও গত কয়েক বছরে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। দেশের একজন নাগরিক হিসেবে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’— এই শব্দ যুগল আজ আর কারও অজানা নয়।
গেল দশকে বিভিন্ন সরকারি ব্যবস্থায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই ‘ডিজিটালাইজেশন’ বা কম্পিউটারভিত্তিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ও তার সুফল প্রশংসনীয়।
শুধু স্বাস্থ্য খাতের কথাই যদি ধরা হয়, তবে দেখা যাবে যে তথ্যপ্রযুক্তির সফল প্রয়োগে সারা দেশের প্রায় সব জেলা ও উপজেলাভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী অফিস-হাসপাতালগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য একীভূত করার একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়িত হয়েছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে স্বাস্থ্য অধিদফতর স্বাস্থ্যসংক্রান্ত তথ্যসমূহ প্রযুক্তিনির্ভর নেটওয়ার্কের মধ্যে নিয়ে এসেছে। ফলে বর্তমানে খুব স্বল্প সময়ে দেশব্যাপী স্বাস্থ্যসংক্রান্ত তথ্যের হালনাগাদ, তাৎক্ষণিকভাবে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত নির্দেশনা প্রদান এবং একই সঙ্গে সেবার মান যাচাই বা মনিটরিং করা যাচ্ছে।
এ অধিদফতরের কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ হলো– ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়েই-হেলথ ও টেলিমেডিসিন সেবা কার্যক্রম, ‘স্বাস্থ্য বাতায়ন’-এর ১৬২৬৩ নম্বরের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক কল সেন্টারের সুবিধা, স্বাস্থ্য খাতে ই-ফাইলিং সেবার মাধ্যমে ‘কাগজবিহীন’ অফিস তৈরি, আজীবন স্বাস্থ্য দলিল বা লাইফ টাইম হেলথ রেকর্ড প্রদানে আইসিআর (ইনটেলিজেন্ট ক্যারেক্টার রিকগনিশন) মেশিনের মাধ্যমে অনলাইন পপুলেশন হেলথ রেজিস্ট্রি, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, ব্যবস্থাপনা এবং রোগের প্রাদুর্ভাব, ধরন ও নিয়ন্ত্রণে জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেম (ভৌলোলিক অবস্থার তথ্য ব্যবস্থা) বা জিআইএস পদ্ধতি প্রয়োগ এবং সর্বোপরি উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত একটি কেন্দ্রীয় তথ্য ভাণ্ডার বা ডাটাবেজ (জাতীয় স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থা-DHIS2) তৈরি ও এর বহুমুখী ব্যবহার কার্যকর করা।তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ও উন্নয়নের প্রভাব যখন স্বাস্থ্য খাতে বিদ্যমান, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে– কোভিড-১৯ রোগের মতো মহামারী নিয়ন্ত্রণে এই ডিজিটাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কতটুকু অবদান রাখছে? কিংবা এ ধরনের অবস্থা মোকাবেলায় আরও কী কী প্রস্তুতি বা সংযোজন প্রয়োজন?
মনে রাখতে হবে যে নতুন কোনো প্রাদুর্ভাব মানেই একটি ক্রমাগত পরিবর্তনশীল রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকার ব্যবস্থার মুখোমুখী হওয়া। কারণ এ নিয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানী কিংবা চিকিৎসকদের কাছেও রোগটি বা রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুটি অপরিচিত।
তাই এর মোকাবেলায় দেশের স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিজে যেমন অবগত থাকা দরকার, এর সঙ্গে সম্পৃক্ত সব সেবাদানকারীকেও প্রতিনিয়ত নতুন তথ্য জানিয়ে হালনাগাদ করা জরুরি। কোভিড-১৯ কিংবা পরবর্তী যে কোনো মহামারীর ক্ষেত্রেই তাই তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন বুঝতে হবে এবং সেই অনুযায়ী জরুরি ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্ব প্রস্তুতি থাকতে হবে এখন থেকেই। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ওয়েবসাইটে ইতিমধ্যেই ‘করোনা’সংক্রান্ত একটি আলাদা তথ্য ভাণ্ডার তৈরি করা হয়েছে, যেখানে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত বাংলাদেশি অ্যাপ, জেলাভিত্তিক তথ্যের ড্যাস বোর্ড, গাইডলাইন, পিপিই ও অন্যান্য লজিস্টিকের তথ্য এবং একটি সার্ভিল্যান্স সিস্টেম রয়েছে।
স্বল্প সময়ে এই বিষয়গুলো অনলাইনে নিয়ে আসা ও বেশিরভাগ তথ্যই সাধারণ জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার এই প্রক্রিয়াটি প্রশংসনীয়। এগুলোর পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজিটাল কার্যক্রমগুলো আরও যেসব স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মকাণ্ডে অবদান রাখতে পারে; সেই সম্পর্কে কিছু আলোচনা বাঞ্ছনীয়।
স্বল্পমেয়াদি— • স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কলসেন্টারসমূহ (১৬২৬৩ ও ৩৩৩)-এর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় স্বল্পকালীন মেয়াদে লোকবল বৃদ্ধি করা।
• বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিশ্বাসযোগ্য তথ্যের আদান-প্রদান নিশ্চিত করা। এই ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ে কর্মীদের প্রয়োজনীয়তা বোঝানো এবং অনলাইনভিত্তিক উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেয়া। এমনকি প্রশিক্ষণসংক্রান্ত কিছু নমুনা-টেম্পলেট আগেই তৈরি করে রাখা এবং দ্রুত হালনাগাদ করে কাজে ব্যবহার করা।
• নতুন রোগ এবং এর প্রতিকার সম্পর্কে সঠিক তথ্য সম্পর্কে অন্যান্য মন্ত্রণালয়কে অবগত করা যে শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়/অধিদফতরের দ্বারা প্রচারিত তথ্যের ওপর আস্থা রাখতে হবে। এই ক্ষেত্রে কেবল তথ্য-উপাত্ত অনলাইনে প্রচার করলেই হবে না; বরং বিভিন্ন টিভি চ্যানেল, পাড়া-মহল্লায় মাইকিং এবং সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে এর ঢালাও প্রচার করতে হবে যে জনসাধারণ কোথায় গিয়ে এই তথ্যসমূহ খুঁজবে।
একই সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগব্যবস্থার মাধ্যমেও অনেক ভুল তথ্য বা গুজব ছড়িয়ে পড়ে, তা মোকাবেলা করার জন্য এই একই পন্থা কার্যকর করতে হবে। • এ ছাড়া এই একই তথ্য উৎস থেকেই সেবাপ্রাপ্তির সুযোগ, প্রতিরোধমূলক সেবা, রোগ নির্ণয় এবং প্রতিকারমূলক সেবার বিষয়ে জনসাধারণকে সার্বক্ষণিক তথ্য প্রদান করার মাধ্যমে কী কী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং লক্ষণসমূহ দেখা দিলে চিকিৎসার জন্য কোথায় যেতে হবে— এসব প্রয়োজনীয় তথ্যসমূহের বিষয়ে জনসাধারণকে ভালোভাবে অবগত করা এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে সংযুক্ত করা।
• বর্তমানে দেশে প্রায় ১০ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছেন, যার মধ্যে সিংহভাগই মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। ইন্টারনেট ব্যবস্থা হাতের মুঠোয় হওয়ায় আজকাল সহজেই স্বাস্থ্যসংক্রান্ত তথ্য সাধারণ জনগণের কাছে দ্রুত পৌঁছে দেয়া সম্ভব হচ্ছে।
মহামারীর সময় প্রাপ্ত তথ্যগুলোকে তাই শুধু সনাতন পদ্ধতিতে প্রকাশ না করে আরও দৃষ্টিনন্দিত উপায়ে শিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিত সাধারণ জনগণের জন্য বোধগম্য করতে ইনফোগ্রাফিক্সের (রঙিন ছবিযুক্ত তথ্য-উপাত্তের) সাহায্যে অনলাইনে তুলে ধরতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদি—
• আজীবন স্বাস্থ্য দলিল বা লাইফটাইম হেলথ রেকর্ড প্রদানে যেই অনলাইনভিত্তিক পপুলেশন হেলথ রেজিস্ট্রির কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে, তাতে এ ধরনের মহামারীর কথা মাথায় রেখে শুরু থেকেই এটিকে প্রয়োজনীয় মন্ত্রণালয়গুলোর (যেমন ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতর, বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়) সঙ্গে সংযুক্ত করে কর্মপরিকল্পনা করা প্রয়োজন।
আমরা জানি যে, এ কার্যক্রমের মাধ্যমে যে কোনো সার্ভে বা হাসপাতালে সেবা নেয়ার সময় একটি নির্দিষ্ট পরিচিত নম্বরের মাধ্যমে ব্যক্তির রোগ সংক্রান্ত লিপিবদ্ধ তথ্যের সন্ধান পাওয়া যাবে। সুতরাং ভবিষ্যৎ মহামারী কিংবা অন্য কোনো স্বাস্থ্যবিধান মেনে চলার ক্ষেত্রে যেখানে রোগীর চলাচল ও গতিবিধি নজরদারিতে রাখা প্রয়োজন, সেটি যেন বাস্তবায়ন সহজ হয়; সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
উল্লেখ্য, স্বাস্থ্য অধিদফতরকে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। এসব ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা রক্ষায় যেন সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়া হয়। • তথ্যনির্ভর এই যুগে এটি আর অজানা নয় যে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-উপাত্ত এবং এর সঠিক বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে পরবর্তী সব কার্যক্রমের পরিকল্পনা ও বাজেট নির্ধারণ করা অনেকাংশে নির্ভর করে। এতে এক দিকে যেমন পরিকল্পিত কার্যক্রমগুলো সফলভাবে পরিচালিত হয়, অন্যদিকে এটি সরকারের সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করে।
তাই তথ্য নথিভুক্তকরণ (রেকর্ডিং) এবং বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) বিভাগ এবং রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)-এর সক্ষমতা এবং সংযুক্তিতা জোরদার করা অত্যাবশ্যক।
জেলাপর্যায়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন, যেন জেলাভিত্তিক প্রয়োজনীয়তাগুলো নির্ণয় করা সম্ভব হয়।
• দীর্ঘদিন ধরে নানান আলোচনার পরেও আমরা দেখছি যে ‘স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় (গ্রামীণ)’ এবং ‘স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় (নগর)’ এর মধ্যে সমন্বিত তত্ত্বাবধানের তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।
এই কোভিড-১৯ নামক বৈশ্বিক মহামারীটি বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় যে, নগর ও গ্রামীণ এলাকার জন্য একটি একক বা সমন্বিত তত্ত্বাবধান পদ্ধতির প্রয়োজন। তাই স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে জেলাপর্যায়ে নগর ও গ্রামীণ উভয় এলাকার রোগীদের তথ্য সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারকেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে এগিয়ে আসতে হবে।
সরকার এবং সব নীতিনির্ধারককে মনে রাখতে হবে যে, সার্বিক উন্নয়নে অবকাঠামোভিত্তিক বা শিল্পভিত্তিক উন্নয়নের যেমন প্রয়োজনীয়তা আছে, তেমনি স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নকে পেছনে রেখে এগিয়ে গেলে সেটি সামগ্রিকভাবে উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
দেশের আর্থিক উন্নয়নের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ দেখতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার মন্ত্রণালয়ের জন্য, বিশেষ করে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত তথ্যব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করতে অনেক বেশি অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন পড়বে। পরবর্তী বাজেট প্রকাশের আগে নীতিনির্ধারকদের এই বিষয়গুলো পুনর্বিবেচনা করার অনুরোধ রইল।
লেখক: ড. রুমানা হক, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ওতারানা ফেরদৌস, সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, আর্ক ফাউন্ডেশন