খামারে মুরগি নেই, মাকড়সায় জাল বুনেছে। বাজারে ডিম ও মুরগির দাম নেই, পাইকারদেরও দেখা নেই। তাই মুরগির বাচ্চাও কিনছেন না খামারিরা। যাদের খামারে ডিম পাড়া মুরগি আছে তারাও খরচের টাকা তুলতে না পেরে বিক্রি করে দিচ্ছেন। প্রায় ৩৫ টাকা খরচে উত্পাদিত মুরগির বাচ্চা মাত্র এক টাকাতেও বিক্রি করতে না পেরে মাটি চাপা দিতে বাধ্য হচ্ছে ব্রিডার ফার্মগুলো। ব্রিডার ফার্ম মালিকদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্যই মিলছে।
এসব কারণে ‘কোভিড-১৯’ চলমান পরিস্থিতিতে আগামী জুন-জুলাই নাগাদ পোলট্রি শিল্পে জড়িত ১৫ থেকে ২০ লাখ মানুষ বেকার হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে পোলট্রি শিল্পের কেন্দ্রীয় সংগঠন ‘বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল’ (বিপিআইসিসি)। সংগঠনটি বলছে, এ শিল্পের সঙ্গে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে, যার প্রায় ৪০ শতাংশই নারী। করোনা ভাইরাসের প্রভাবে চরম সংকটে পড়েছে এ শিল্পটি। বিশেষ করে গ্রামের তৃণমূল ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের দুর্দশা চরমে। করোনার প্রভাবে এ বিপুল সংখ্যক মানুষই শুধু যে বেকার হবে তাই নয়; এর পাশিপাশি এদের ওপর নির্ভরশীল আরো প্রায় ৩০ লাখ মানুষের জীবনেও নেবে আসবে দারিদ্র্য। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি ভয়াবহ এক পরিণতির মুখোমুখি হতে চলেছে।
বিশ্লেষণ করে বিপিআইসিসি জানিয়েছে, ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ব্রিডার্স ইন্ডাস্ট্রিতে ক্ষতি হবে ১ হাজার ৪২০ কোটি, ফিড ইন্ডাস্ট্রিতে ২৫৫ কোটি, বাণিজ্যিক পোলট্রি (ডিম ও মাংস) ১ হাজার ৬১৫ কোটি এবং প্রসেসড ইন্ডাস্ট্রিতে ১০৮ কোটি টাকা। এছাড়া এ সেক্টরে ওষুধ, মিনারেল, প্রিমিক্স ইত্যাদিতে ১৫১ কোটি টাকা। চলতি মাসের শেষ নাগাদ এ পরিমান দাঁড়াবে আনুমানিক ৩ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা।
পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়বে। আর এমনটি হলে জুন-জুলাই মাস নাগাদ পোলট্রি শিল্পে বিনিয়োগকৃত মূলধনের ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ হারিয়ে যাবে। সারাদেশে প্রায় অর্ধেকেরও বেশি খামার বন্ধ হয়ে যাবে। ব্রিডার ফার্ম/হ্যাচারিগুলোর উত্পাদন ৯০ শতাংশ হ্রাস পাবে। পোলট্রি ও মাছের খাবার উত্পাদনকারী ফিড মিলগুলোর উত্পাদনও অর্ধেকে নেমে আসবে। গত ১১ এপ্রিল নাগাদ এ শিল্পে প্রায় ১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
বিপিআইসিসির সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, তৈরি পোশাক শিল্পের পর পোলট্রি শিল্পই দেশে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। তবে তৈরি পোশাক শিল্প শহরভিত্তিক হলেও পোলট্রি শিল্প মূলতই শহরের বাইরে বা গ্রামীণ এলাকায় গড়ে উঠেছে। অসংখ্য বেকার যুবক স্বাবলম্বী হয়েছে এ শিল্পকে ঘিরেই। পোলট্রি অসংখ্য নারীর জীবনের গল্প বদলে দিয়েছে।তৃণমূল অসংখ্য মানুষের কথা বিবেচনা করে এবং সেই সঙ্গে সস্তায় প্রোটিন সরবরাহকারী প্রধানতম এ খাতটিকে রক্ষার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। মসিউর রহমান বলেন, বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতির যেভাবে অবনতি ঘটছে তাতে স্বাস্থ্যখাতের পরই সবচেয়ে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে কৃষি, পোলট্রি, ডেইরি, মত্স্য প্রভৃতি খাতগুলোকে। কারণ খাদ্য ও পুষ্টির জোগান দিতে না পারলে আগামীতে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। তিনি বলেন, ডেইরি খাতের জন্য সরকার প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছেন; এর পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকসহ দাতাগোষ্ঠীদের সহায়তায় প্রায় ৫০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প রয়েছে। কৃষিখাতের জন্যও ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। এর মাঝে পোলট্রির জন্য বরাদ্দ আসলেই কতটুকু সেটি এখনো সুস্পষ্ট নয়।
বিপিআইসিসি প্রস্তাব হচ্ছে, পোলট্রি শিল্পের জন্য সহায়তা প্যাকেজকে প্রধানত দুইটি ধাপে চিন্তা করতে হবে। এ মুহূর্তে যে সিদ্ধান্তটি সবচেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ তা হলো—মার্চ থেকে আগস্ট-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পোলট্রি সংশ্লিষ্ট সবগুলোর খাতের জন্য ব্যাংক ঋণের কিস্তি স্থগিত করা এবং অন্তত ৬ মাসের সুদ মওকুফ করা। সেই সঙ্গে প্রণোদনায় ঘোষিত ঋণ সুবিধা যেন তৃণমূল খামারিরা সত্যিকার অর্থেই পায় তা নিশ্চিত করা। দ্বিতীয় আগামী অন্তত ৫ বছরের জন্য এ শিল্পটিকে কর অব্যাহতি খাত হিসেবে ঘোষণা করা। পোলট্রি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দরিদ্র মানুষের জন্য সরকার যে খাদ্যসহায়তা দিচ্ছে তাতে ডিম, মুরগি অন্তর্ভুক্ত করলে এবং টিসিবির তালিকায় ডিম, মুরগি অন্তর্ভুক্ত করলে অবিক্রীত ডিম-মুরগির এক বড়ো অংশ বিক্রির আওতায় আসবে।