করোনায় সৃষ্ট পরিস্থিতিতে কর্মহীন হয়ে পড়া দরিদ্র মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছানোর চেষ্টা করছে সরকার। কিন্তু সমন্বয়ে ত্রুটি এবং বণ্টন ব্যবস্থায় দুর্বলতার কারণে সবার কাছে ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না। আর এই অবস্থা আরও কিছুদিন চললে খাবারের জন্য মানুষ রাস্তায় নেমে আসবে।
এর ফলে লকডাউনের কোনো মূল্য থাকবে না। তাই বণ্টন ব্যবস্থায় আরও সমন্বয় দরকার। যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা বলেছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে খাবার পৌঁছাতে হবে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে (এনজিও) ব্যবহার করা যেতে পারে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জরিপে বলা হয়েছে, দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সহায়তার জন্য বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে সরকার।
এসব কার্যক্রমের আওতা অত্যন্ত সীমিত হওয়ায় ওই জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের বাইরে থেকে যাচ্ছে। দেশের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন জনগোষ্ঠীর প্রায় ৮২ ভাগ কোনো সামাজিক সুরক্ষা সুবিধার আওতায় নেই। এ ছাড়াও সামাজিক সুরক্ষার বাইরে রয়েছে ৭১ ভাগ শিশু।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় কাজ ত্রাণের সুষ্ঠু বণ্টন। এ ক্ষেত্রে সবার কাছে খাদ্য পৌঁছাতে হবে। না হলে মানুষ রাস্তায় বের হয়ে আসবে। ফলে লকডাউনের মূল্য থাকবে না। তিনি বলেন, দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে খাবার পৌঁছাতে হবে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী খাবার পৌঁছানোর জন্য বেশকিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রতিটি জেলার জন্য একজন সচিবকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তার সঙ্গে স্থানীয় এনজিও প্রতিনিধি এবং দলমত নির্বিশেষে সব ধরনের রাজনীতিবিদকে অংশ নিতে হবে। না হলে সুষ্ঠু বণ্টন মুশকিল।
তিনি বলেন, সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির অবস্থা আশঙ্কাজনক। ইতোমধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে পূর্বাভাস দিয়েছে। তাতে মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ২-৩ শতাংশের মধ্যে নেমে আসবে-এমন আশঙ্কা করা হয়েছে। তবে সবকিছু নির্ভর করবে, এই পরিস্থিতি কতদিন দীর্ঘ হবে, তার ওপর। এই পরিস্থিতি আরও ৬ মাস চললে অর্থনীতি নেতিবাচক অবস্থায় চলে আসবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইন্সটিটিউট অব গর্ভনেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) জরিপে বলা হয়েছে, করোনার কারণে দেশের ৭০ শতাংশ দরিদ্র মানুষের আয় বন্ধ হয়েছে। এ ছাড়াও নতুন করে দরিদ্র হতে পারে আরও ২০ শতাংশ মানুষ। এ অবস্থায় দরিদ্রদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য সরকারকে পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতে হবে।
পিপিআরসির নির্বাহী পরিচালক হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, কিছু মানুষ আগে দারিদ্র্যসীমার ৪০ শতাংশ ওপরে ছিল। বর্তমানে ওই শ্রেণির ৮০ শতাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে এসেছে। মোট দরিদ্রের হিসাবে এটি ২০ শতাংশ কম হবে না।
তিনি বলেন, খাদ্য সবার কাছে পৌঁছাতে হবে। এ ক্ষেত্রে ওএমএস (খোলা বাজারে পণ্য বিক্রি) পদ্ধতি চালু রাখতে হবে। কারণ, শহরে বস্তিতে বসবাসরত ৮২ শতাংশ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। আর গ্রামাঞ্চলে কর্মহীন হয়েছে ৭৯ শতাংশ দরিদ্র মানুষ।
হোসেন জিল্লুর রহমান আরও বলেন, কোভিড-১৯-এর প্রভাবে কর্মহীন ও আয় বন্ধ হয়ে যাওয়া দরিদ্র মানুষের জন্য নগদ টাকা দেয়া জরুরি। সে ক্ষেত্রে প্রতি মাসে দরিদ্রদের জন্য খরচ হবে ৫ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা। দেশে এখন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা তিন কোটি ৮১ লাখ ৫৬ হাজার ৬৬৯ জন। যার মধ্যে গ্রামে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দুই কোটি ৬৯ লাখ ৬৪ হাজার ৫৩০ জন। আর শহরে এক কোটি ১১ লাখ ৯২ হাজার ১৩৯ জন।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সরকার বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছে খাবার পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। তারপরও আমরা দেখছি বেশকিছু মানুষ এই সুবিধার বাইরে রয়ে গেছে। এতে অপর্যাপ্ত সাহায্যের একটি বৃত্ত তৈরি হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সরকারি সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র চাওয়া হচ্ছে। যারা ভাসমান মানুষ আছেন তাদের কাছে জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। ফলে তারা সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
তিনি বলেন, ভাসমান মানুষ যারা ফুটপাতে থাকেন, যারা বস্তিতে থাকেন, যারা আজ এখানে কাল ওখানে থাকেন, তাদের কাছে সাহায্য পৌঁছাচ্ছে না। এটি একটি বড় সমস্যা। এরা শহরে বড় একটি সংখ্যা বলে আমাদের কাছে মনে হচ্ছে। বেদে, কামার, কুমার, যৌনকর্মীরা বঞ্চিত হচ্ছে বলে আমাদের কাছে মনে হচ্ছে। ড. দেবপ্রিয় বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রণোদনা পৌঁছানো খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ, সরকারের কাছে এদের তথ্য-উপাত্ত সেভাবে নেই। সরকারের পক্ষ থেকে যেসব কাজ করা হচ্ছে, তা তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। সে ক্ষেত্রে যারা তৃণমূল মানুষকে নিয়ে কাজ করে তাদের ব্যবহার করলে সরকার আরও দ্রুত ও কার্যকরভাবে এসব মানুষের কাছে সাহায্য পৌঁছাতে পারবে।