চার মাস ধরে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মসজিদভিত্তিক গণশিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষকরা।
গত ডিসেম্বরে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ‘মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কাযর্ক্রম’ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় সারা দেশের মোট ৭৪ হাজার ৭৭৮টি কেন্দ্রের প্রায় ৭৫ হাজার শিক্ষকের বেতন বন্ধ রয়েছে।
বেতন না পাওয়া এসব শিক্ষক বিদ্যমান করোনা পরিস্থিতিতে অনাহারে-অর্ধাহারে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এই শিক্ষকদের বেশির ভাগই মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জিন ও খাদেম।
করোনার কারণে মসজিদ বন্ধ থাকায় বেতনও প্রায় অনিশ্চিত। প্রতি বছরের মতো ঘটা করে রমজানের তারাবি না হওয়ায় বাড়তি হাদিয়া থেকেও বঞ্চিত হবেন হাফেজ, ইমাম, মোয়াজ্জিন-খাদেমরা। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
বেতন না পাওয়ার বিষয়টি সত্যতা স্বীকার করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (ইফা) মহাপরিচালক আনিস মাহমুদ বলেন, ‘শিগগিরই এই সমস্যার সমাধান হবে। গত ডিসেম্বরে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়েছে।
প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবের সার-সংক্ষেপ অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রস্তাবটিতে সম্মতি দিয়েছে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি)।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) আগামী বৈঠকে প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। অনুমোদন পাওয়া সাপেক্ষে প্রকল্পটির সমস্যার সমাধান হবে ইনশাআল্লাহ। করোনা পরিস্থিতির সৃষ্টি না হলে এতদিন এই সমস্যার সমাধান হতো।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক জানান, ‘মসজিদে ইমামতির পাশাপাশি একটি কেন্দ্রে পড়াই। মসজিদ থেকে বেতন পাই সাড়ে তিন হাজার টাকা।
কেন্দ্র থেকে পাই সাড়ে চার হাজার টাকা। এছাড়া তিনটি টিউশনি করে পাঁচ হাজার টাকা পাই। এই ১৩ হাজার টাকায় ৬ জনের সংসার টেনেটুনে চলে। করোনার কারণে মসজিদ ও সব টিউশনি বন্ধ।
মসজিদের বেতন হবে কিনা জানি না। চার মাস ধরে শিক্ষকতার বেতন পাই না। কিভাবে সংসার চলছে আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। সন্তানদের মুখের দিকে তাকাতে পারি না।
ছোট দুই বছরের বাচ্চার জন্য দুধ কেনার ও দু’মুঠো খাবারের জন্য কোনো টাকা নেই হাতে। ইতোমধ্যে স্ত্রীর গহনা বন্ধক রেখে কিছু টাকা নিয়েছি। তাতেই চলছে সংসার। কারো কাছে কিছু চাইতেও পারছি না।’
ওই শিক্ষক জানান, এই প্রকল্পের বেশির ভাগ শিক্ষকই হয় মসজিদের ইমাম, নয়তো মোয়াজ্জিন অথবা খাদেম। তারা এসব ছাড়াও আরবি টিউশনি করে কোনো রকমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।
প্রকল্পের বেতন বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি করোনার কারণে মসজিদ ও সব টিউশনি বন্ধ হয়ে গেছে। এখন এসব শিক্ষক না পারছেন কারো কাছে বলতে, না পারছেন কোনো সাহায্য চাইতে।
সূত্র জানায়, মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্প ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বৃহৎ প্রকল্প। ১৯৯৩ শুরু হওয়া এ কার্যক্রমের ইতোমধ্যে ৬টি পর্যায় শেষ করে এটিকে ৭ম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ প্রকল্পে মসজিদের ইমামগণ মসজিদকেন্দ্রে শিশু ও বয়স্ক শিক্ষার্থীদের বাংলা, অংক, ইংরেজি, আরবি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধসহ বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দান করছেন।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সুবিধাবঞ্চিত স্থানে এ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তার ও কোর্স সম্পন্নকারীদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হচ্ছে। এ প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের বেশির ভাগই সমাজের অবহেলিত, দরিদ্র ও নিরক্ষর জনগোষ্ঠী।
ধারাবাহিকভাবে চলমান এ প্রকল্পটির আওতায় প্রথম পর্যায়ে মোট ৯৪ হাজার ৫৯০ জন, দ্বিতীয় পর্যায়ে মোট সাত লাখ ২৩ হাজার ৮৮০ জন, তৃতীয় পর্যায়ে মোট ১৬ লাখ ৪৩ হাজার ৪০ জন শিক্ষার্থীকে শিক্ষাদান করা হয়।
একই ধারাবাহিকতায় চতুর্থ পর্যায়ে প্রকল্পের মাধ্যমে ২৯ লাখ ৩৭ হাজার ৬০০ জন শিক্ষার্থীকে প্রাক-প্রাথমিক ও পবিত্র কুরআন শিক্ষা দান করা হয়। পঞ্চম পর্যায়ে ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৬৫ লাখ ৩৫ হাজার ২০০ জন শিক্ষার্থীকে শিক্ষাদান করা হয়েছে, যার অগ্রগতি শতভাগ।
২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর একনেকে এক হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ রেখে ২০১৫ হতে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর মেয়াদে ‘মসজিদভিত্তিক শিশু গণশিক্ষা কার্যক্রম’ শীর্ষক ষষ্ঠ পর্যায় প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। এ প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি ৯৭ শতাংশ বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
জানতে চাইলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সচিব কাজী নূরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রকল্পটি সরকারের বিশেষ বিবেচনায় বাস্তবায়িত হচ্ছে।
সপ্তম পর্যায়ে প্রকল্প অনুমোদনের পূর্ব পর্যন্ত প্রকল্পের প্রধান কার্যালয়সহ জেলা ও উপজেলা শিক্ষাকেন্দ্র, দারুল আরকাম মাদ্রাসা এবং রিসোর্স সেন্টারের কাযর্ক্রম চলমান রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
আশা করছি সপ্তম পর্যায়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পের সঙ্গে পাবলিক সেন্টিমেন্ট বা জনগণের অনুভূতি জড়িত। ইচ্ছা করলেই প্রকল্প বন্ধ করা যাবে না। বর্তমানে শিক্ষকদের মাসে সাড়ে চার হাজার টাকা বেতন দেয়া হচ্ছে। সামনে তা বাড়িয়ে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা করার প্রস্তাব রয়েছে।’