• ২০২৪ এপ্রিল ১৬, মঙ্গলবার, ১৪৩১ বৈশাখ ৩
  • সর্বশেষ আপডেট : ০১:০৪ পূর্বাহ্ন
English
পরিচালনাপর্ষদ
আমাদের সাথে থাকুন আপনি ও ... www.timebanglanews.com

সেই ঐতিহাসিক সুয়েজ খাল যেভাবে মিশরের হাত থেকে কেড়ে নেবার চেষ্টা করেছিল ব্রিটেন ও ফ্রান্স

  • প্রকাশিত ১১:০৪ অপরাহ্ন মঙ্গলবার, এপ্রিল ১৬, ২০২৪
সেই ঐতিহাসিক সুয়েজ খাল যেভাবে মিশরের হাত থেকে কেড়ে নেবার চেষ্টা করেছিল ব্রিটেন ও ফ্রান্স
ফাইল ছবি
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

রিপোর্টার, অলোক
২৫.০৫.২০২১

সুুয়েজ খাল পৃথিবীর অন্যতম প্রধান তেলবাহী জাহাজ চলাচলের পথ।

বিবিসি এক প্রতিবেদনে বলেন, মিশরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসের সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করেছিলেন ১৯৫৬ সালে- দখল করে নিয়েছিলেন মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল রপ্তানির অন্যতম প্রধান পথটির নিয়ন্ত্রণ।

ফ্রান্স ও ব্রিটেন তখন তার হাত থেকে সেই নিয়ন্ত্রণ আবার কেড়ে নেবার চেষ্টা করে। তারা পোর্ট সইদে এক যৌথ আক্রমণ চালায়।

সেই অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন এমন একজন তরুণ ব্রিটিশ সৈন্যর সাথে কথা বলেছেন বিবিসির এ্যালান জনস্টন।

সেই স্মৃতিচারণ নিয়েই ইতিহসের সাক্ষীর এই পর্ব।

১৯৫৬ সালের নভেম্বর মাস। মিশরের হাত থেকে সুয়েজ খালের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে এই খালেরউত্তর প্রান্তে পোর্ট সঈদে এক বড় রকমের সামরিক অভিযান চালায় ব্রিটেন ও ফ্রান্স।

ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একজন রিজার্ভ সৈন্য ছিলেন টনি বান্স - তার বয়স তখন মাত্র ২০ বছর।আক্রমণের দিন ভোরবেলা পোর্ট সঈদের সৈকতে অবতরণ করেন তিনি।

টনি বান্স আসলে ছিলেন একজন চিকিৎসাকর্মী - যিনি কাজ করতেন রাজকীয় মেরিন নৌসেনাদের পাশাপাশি।

তার এখনো স্পষ্ট মনে আছে তার চারপাশ থেকে আসতে থাকা সেই যুদ্ধের শব্দ।

"চারদিকে শুধু প্রচণ্ড বিস্ফোরণ, গুলি, আর ভারী জিনিস মাটিতে পড়ে যাবার শব্দ। লোকে চিৎকার করছে।"

"...আসলে সেই অবস্থার বর্ণনা দেয়া খুব কঠিন। একটু পর পর মেশিনগানের গুলির শব্দ, আরো নানা রকম আগ্নেয়াস্ত্র - ব্রেনগান, স্টেনগানের শব্দ। সমুদ্র থেকে জাহাজের নিক্ষিপ্ত গোলা এসে পড়ছে।"

"মাথার ওপরে উড়ছে রয়াল এয়ার ফোর্সের যুদ্ধ বিমান - তারাও ওপর থেকে লোকজন দেখতে পেলেই কামান থেকে গুলি করছে। এটা ছিল একটা বিরাট সমস্যা - কারণ তাতে মিশরীয় সৈন্যদের চাইতে আমাদের লোকেরাই বেশি আহত হচ্ছিল।"

"চোরাগোপ্তা বন্দুকধারাীরা নানা জায়গা থেকে গুলি করছিল। যতদূর চোখ যায় আমি দেখতে পাচ্ছিলাম - মরুভূমিতে গুলি এসে পড়ার পর বালু ছিটকে উঠছে। আপনি যদি সৈকতের ওপর দিয়ে দৌড় দিতে যান, তাহলে আপনি একেবারে অরক্ষিত একটি টার্গেটে পরিণত হবেন।"

"এর পর আমাদের যে কাজটা ছিল তা হলো আহত লোকজনকে ফিরিয়ে আনা। আমরা সৈকতের ওপর চিকিৎসা দেয়ার কোন কাজই করতে পারছিলাম না।"

টনি বান্সের জন্য যুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এটাই প্রথম।

"আমার মনে হয়, সেসময় আপনি যদি কোথাও কোন মিশরীয়কে দেখতে পান এবং তার হাতে বন্দুকের মত দেখতে কোন কিছু থাকে - তাহলে আপনার প্রথম প্রতিক্রিয়া হবে তাকে হত্যা করার চেষ্টা করা। কারণ সে-ও কিন্তু আপনার বা আপনার সহকর্মীর বিরুদ্ধে একই কাজ করার জন্য প্রস্তুত।"

"সেই সৈকতের ওপর শ'খানেক লোক সবাই নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ করছিল। "

"আমাদের প্রতিপক্ষ কিন্তু সামনাসামনি লড়াই করছিল না। তারা স্নাইপিং বা চোরাগোপ্তা গুলি করছিল। তারা ছিল সৈকতের পাশের বাড়িগুলোর ভেতরে, জানলা খুলছিল, গুলি করছিল।"

টনি বান্স যে যুদ্ধের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন - তার শুরু প্রেসিডেন্ট নাসেরের একটি ভাষণ থেকে।

আলেকজান্দ্রিয়া শহরে এক গ্রীষ্মের রাতে প্রেসিডেন্ট গামাল আবদুল নাসের জনতার উল্লাসের মধ্যে ঘোষণা করলেন - "মিশর সুয়েজ খালকে জাতীয়করণ করেছে।"

পৃথিবীর জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ তেল পরিবহনের একটি পথ এই সুয়েজ। প্রেসিডেন্ট নাসের মনে করলেন, এই খাল থেকে যে রাজস্ব আয় হয় তা দিয়ে তিনি তার দরিদ্র দেশের উন্নয়ন ঘটাতে পারবেন।

কিন্তু নাসেরের এ পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা করলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এ্যান্টনি ইডেন।

মি. ইডেন বললেন, "তিনি একটি আন্তর্জাতিক কোম্পানি দখল করে নিয়েছেন - কোন পারস্পরিক আলোচনা ছাড়া, কোন সম্মতি ছাড়া। যে কোম্পানির আইনী অধিকার মিশরের সরকারের সাথে করা বিভিন্ন চুক্তি দিয়ে সংরক্ষিত ছিল।"

"কেউ হয়তো বলবেন, জেনারেল নাসের খাল দিয়ে চলাচলকারী জাহাজের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার প্রতিশ্রুত দিয়েছেন। তাহলে কেন তাদের বিশ্বাস করা যাবে না? আমার উত্তর হলো, তিনি অতীতে কী করেছেন সেদিকে তাকান।"

এ্যান্টনি ইডেন মনে করতেন, নাসের হচ্ছেন একজন গভীরভাবে অগ্রহণযোগ্য স্বৈরাচারী একনায়ক।

আর ফরাসীরা মনে করতো, প্রতিবেশিী আলজেরিয়ায় বিদ্রোহ উস্কে দিচ্ছেন নাসের।

কাজেই ইসরায়েলকে সাথে নিয়ে ব্রিটেন ও ফ্রান্স নাসেরের বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্র করলো। গোপনে ঐকমত্য হলো, ইসরায়েল মিশরকে আক্রমণ করবে এবং তারপর সুয়েজ খালকে রক্ষার কথা বলে ব্রিটেন ও ফ্রান্স এটি দখল করে নেবে।

এই পরিকল্পনার সাংকেতিক নাম দেয়া হলো 'অপারেশন মাস্কেটিয়ার।'

কাজেই টনি বান্সের মত সৈন্যদের পাঠানো হলো পোর্ট সঈদে।

সেখানে তিনি যে প্রতিপক্ষের সম্মুখীন হলেন - তাদের ব্যাপারে তার স্মৃতি হলো এমন।

"যখন লড়াই শুরু হলো, মিশরীয়দের কোন একটি মহল থেকে নির্দেশ দেয়া ছিল - কিছু অস্ত্রাগারের দিকে যাওয়ার জন্য। যেগুলো তখন অস্ত্রশস্ত্রে পূর্ণ ছিল। সেখানে ছিল রাইফেল, মেশিনগান ব্রেনগানের মত সব ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র - এসবের গুলি এবং হ্যান্ড গ্রেনেড। লোকে সেখানে গিয়ে লাইন ধরলো - এবং সেখান থেকে তাদের অস্ত্র দিয়ে দেয়া হলো। বলা হলো বাইরে গিয়ে সেই অস্ত্র ব্যবহার করতে।"

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এ্যান্টনি ইডেন (ডানে) হাত মেলাচ্ছেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট মেনজিসের সাথে, মাঝে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেলভিন লয়েড।

"কিন্তু কিভাবে তা ব্যবহার করতে হবে - তা বলা হয়নি। সেই অস্ত্রগুলো ছিল গ্রীজ লাগানো। সাধারণত অস্ত্র সংরক্ষণ করার সময় এটাই করা হয়। কিন্তু তিন-চারটা গুলি করার পর অস্ত্রগুলোর ভেতরে বালু আটকে গিয়ে সেগুলো জ্যাম হয়ে গেল।"

"এটাই হলো তাদের পরাজয়ের কারণ। তারা বন্দুক নিয়ে গুলি করার চেষ্টা করছিল, ট্রিগার টিপছিল, কিন্তু গুলি বের হচ্ছিল না। কারণ অস্ত্রগুলো অকেজো হয়ে গেছে। ফলে তারা সম্পূর্ণ অরক্ষিত হয়ে পড়লো, তাদের পক্ষে বহু লোক নিহত হলো।"

তার মানে , মিশরের সৈন্যরা কি যথাযথভাবে প্রশিক্ষণ পায়নি? তারা কি কীভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতে হয় তা জানতো না?

"হ্যাঁ, ঠিক তাই। কিন্তু এই সৈনিকদের নেতৃত্ব দেবার জন্য কোন অফিসারই ছিল না। যারা ছিল তারা গাড়িতে করে পালিয়ে যাচ্ছিল। যে লোকেরা রয়ে গিয়েছিল তারা ছিল অন্ধ সমর্থক। তারা বলছিল আমি নাসেরের জন্য প্রাণ দেবো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের ভাগ্যে তাই ঘটেছিল।"

তাহলে যুদ্ধ কি ২৪ ঘন্টা পরই কমে এসেছিল?

"আমার মনে হয় ২৪ বা ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই যুদ্ধের আসল সময়টা পার হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার পরও অনেক সমস্যা ছিল। আমাদের বলা হয়েছিল পোর্ট সঈদ শহরে না বেরোতে । আমরা একা বাইরে যেতাম না। সবসময় দলবদ্ধ হয়ে অস্ত্র নিয়ে বেরোতাম। "

"আমাদের বলা হয়েছিল শহরের বড় রাস্তা ছেড়ে অলিগলিতে বা দোকানে না ঢুকতে। আমরা তাই করতাম। একজন অফিসার বড় রাস্তা ছেড়ে গলিতে চলে গিয়েছিল - তাকে আর কখনো পাওয়া যায় নি।"

"জায়গাটা তখন ছিল খুবই বিপজ্জনক। অনেক লোক ছিল - যারা আমাদের বিরুদ্ধে তীব্র শত্রুভাবাপন্ন ছিল। তারা মনে করতো, আমরা তাদের দেশের আগ্রাসন চালিয়েছি - এখানে আসা আমাদের উচিত হয়নি। কাজেই আমাদের ক্ষতি করার সুযোগ পেলে তারা ছাড়তো না।"

কিন্তু টনি বান্সের অন্যতম ভয়াল স্মৃতিগুলো যুদ্ধের নয়, বরং যুদ্ধের পর যা ঘটেছিল - সেই সময়কার।

"আমি সবচেয়ে খারাপ দৃশ্যটি দেখেছিলাম লড়াইয়ের পর যখন আমরা মৃতদেহ পরিষ্কার করছি। দেখলাম একটি ইংরেজ যুগল। হয়তো ছুটি কাটাতে এসেছিল। হয়তো তারা হোটেলের জানলা দিয়ে শুধুই দেখছিল কী ঘটছে। সেসময় একটা বিরাট বিস্ফোরণ হয়। বিস্ফোরণে তাদের দুজনেরই মাথা উড়ে গিয়েছিল - চেয়ারে বসা অবস্থাতেই। দুজন নিরপরাধ মানুষ। তারা নড়ার সুযোগ পায়নি, হয়তো টেরও পায়নি কি হয়েছিল। "

তখন কি রাস্তাতেও মৃতদেহ পড়ে ছিল?

"আমরা একটা কোকাকোলা বা পেপসিকোলার ট্রাক ভাড়া করেছিলাম। তারা মৃতদেহ তুলছিল। আর কিছু লোক ছিল - যারা ক্যাসিনো প্যালেস হোটেলে সামনে সৈকতে বালুতে গর্ত খুঁড়ছিল মৃতদেহগুলো সারিবদ্ধভাবে গণকবর দেবার জন্য।"

"আমরা দুশোরও বেশি মৃতদেহ কবর দিয়েছি। নিহতরা সবাই ছিল মিশরীয়।"

এই মৃত্যু যে কত অর্থহীন ছিল - তা স্পষ্ট হয়ে গেল কিছুদিন পরই।

ব্রিটেন ও ফ্রান্স যে মিশরে আক্রমণ চালাতে যাচ্ছে এ ব্যাপারে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে কিছুই জানায়নি। এ ঘটনায় প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ার অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে কয়েক সপ্তাহ পরই ইউরোপিয়ান শক্তিগুলো সুয়েজ থেকে অপমানজনকভাবে সেনা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হলো।

রাজনৈতিকভাবেও এই এ্যাডভেঞ্চার বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এ্যান্টনি ইডেন বাধ্য হলেন পদত্যাগ করতে। তার সুনামও নষ্ট হলো। সুয়েজ বিপর্যয়ের পর একটি শক্তিধর দেশে হিসেবে ব্রিটেনের বৈশ্বিক অবস্থানও নিচে নেমে গেল।

টনি বান্স বলছিলেন, "আমার মনে হয় না সুযেজের ওই অভিযানকে পৃথিবীর কেউ প্রশংসা করেছে। এটা করে কিছুই জেতা যায়নি, বরং হারাতে হয়েছে অনেক কিছু। বিশেষ করে মানুষের জীবন। আমার মনে হয় এটা ছিল অনর্থক একটা অভিযান।"

সর্বশেষ