বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘাত ও সহিংসতার রেশ ছড়িয়েছে পার্শ্ববর্তী রাঙামাটি জেলায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দুটো জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার খাগড়াছড়িতে অন্তত তিনজন নিহত হবার খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে, যাদের সবাই পাহাড়ি। সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র প্রতিষ্ঠান আইএসপিআর এক বিবৃতির মাধ্যমে জানিয়েছে যে সেনাবাহিনীর সাথে 'গোলাগুলিতে' তিনজন নিহত হয়েছে।
সেনাবাহিনীর ভাষ্য হচ্ছে, তারা 'আত্মরক্ষার্থে' গুলি করেছে। এ পরিস্থিতির জন্য পাহাড়িদের সংগঠন ইউপিডিএফকে দায়ী করছে সেনাবাহিনী।
তবে বিষয়টি নিয়ে নিয়ে ইউপিডিএফ-এর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
দুই পার্বত্য জেলায় সহিংসতার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এর দপ্তর থেকে দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সৃষ্ট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে সরকার।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সকল বাহিনীকে সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে এবং পার্বত্য তিন জেলায় বসবাসকারী সকল জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
শুক্রবার দুপুর দেড়টায় ১৪৪ ধারা জারির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানান রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন।
বাইক চুরিকে কেন্দ্র করে একজন বাঙালিকে পিটিয়ে মারার ঘটনায় স্থানীয় বাঙালি শিক্ষার্থীরা দীঘিনালা সরকারি কলেজ থেকে মিছিল নিয়ে লারমা স্কয়ারে এলে তাদের বাধা দেয় পাহাড়িরা। এতে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়।
দীঘিনালা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নুরুল হক জানান, খাগড়াছিতে একজন বাঙালির মৃত্যুর প্রতিবাদে দীঘিনালা কলেজের ছাত্ররা একটি মিছিল বের করে।
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, মিছিলটি নতুন বাজার ঘুরে লারমা স্কয়ারে এলে মিছিল থেকে এক পাহাড়িকে ঢিল মারা হয়। এর থেকেই সহিংসতার সূত্রপাত হয় এবং এসময় বেশ কয়েকজন আহত হয় বলে জানান তিনি।
শুক্রবারও সেখানে থমথমে পরিস্থিতি রয়েছে। এরইমধ্যে দীঘিনালায় আগুন ও সহিংসতার প্রতিবাদে পাহাড়িদের পক্ষ থেকে শুক্রবার মিছিল বের করলে আবারও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
তবে স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে, ঘটনার শুরু বুধবার থেকে। সেদিন ভোরে খাগড়াছড়ি শহরের নোয়াপাড়া এলাকায় মোহাম্মদ মামুন নামের এক ব্যক্তিকে মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে মারধর করা হয় এবং এই ঘটনার ভিডিও ধারণ করা হয়।
পরে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে তার মৃত্যু হয়।
বাংলাদেশের তিনটি পার্বত্য জেলায় নিরাপত্তা ও শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে গত কয়েক দশক যাবৎ সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে।
খাগড়াছড়ির ঘটনা নিয়ে সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র প্রতিষ্ঠান আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর বা আইএসপিআর শুক্রবার একটি বিবৃতি দিয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, “বৃহস্পতিবার দীঘিনালা কলেজ থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি দীঘিনালার বোয়ালখালী বাজার অতিক্রম করার সময় ইউপিডিএফ (মূল) এর কতিপয় সন্ত্রাসী মিছিলের উপর হামলা করে ও ২০-৩০ রাউন্ড গুলি ছড়ে। এ প্রেক্ষিতে বিক্ষুব্ধ জনতা বোয়ালখালী বাজারের কয়েকটি দোকানে অগ্নিসংযোগ করে।”
বিষয়টি নিয়ে খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মো. আরেফিন জুয়েল বিবিসি বাংলাকে বলেন, “দীঘিনালায় বাঙালি ছাত্ররা একটি মিছিল বের করে। তার আগে শহরে একটি চুরির ঘটনায় একজন চোর প্রথমে এক্সিডেন্ট করে, পরে গণপিটুনিতে মারা যায়। এটার প্রতিবাদেই মিছিল হয়।”
মিছিল থেকে বোয়ালখালী বাজারে ছাত্রদের সাথে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে এবং এক পর্যায়ে তা পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে রূপ নেয় বলে জানান তিনি।
তবে সংঘর্ষ শুরু হবার কারণ হিসেবে দুই পক্ষই একে অপরকে দোষারোপ করছে।
বৃহস্পতিবার বিকেলে স্থানীয় বাঙালিদের প্রতিবাদ মিছিলটি লারমা স্কয়ার এলাকায় গেলে পাহাড়িরা বাধা দেয় বলে মিছিলে উপস্থিত কয়েকজন অভিযোগ করেন। আবার পাহাড়িদের অনেকে পাল্টা অভিযোগ করেন যে মিছিল থেকে পাহাড়িদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে।
এই ঘটনায় পাহাড়িদের ১০০টির মতো দোকান আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় বলে জানান দীঘিনালা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নুরুল হক।
বৃহস্পতিবারের সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন খাগড়াছড়ি জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক কর্মকর্তা রিপল বাপ্পী চাকমা।
হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, নিহত তিনজনই পাহাড়ি। তারা হলেন জুনান চাকমা (২০), ধনঞ্জয় চাকমা (৫০) ও রুবেল (৩০)। এদের মধ্যে একজন দীঘিনালার এবং দুইজন খাগড়াছড়ি সদরের বাসিন্দা।
আইএসপিআর’র বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “খাগড়াছড়ি জোনের টহল দল রাত সাড়ে ১০টায় একজন মুমূর্ষ রোগীকে নিয়ে শহরের স্বনির্ভর এলাকায় পৌঁছালে অবস্থানরত উত্তেজিত জনসাধারণ ইউপিডিএফ (মূল) এর নেতৃত্বে বাধা সৃষ্টি করে।”
বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, “এক সময় ইউপিডিএফ (মূল) এর সন্ত্রাসীরা সেনাবাহিনীর টহল দলের সদস্যদের উপর গুলি করে এবং আত্মরক্ষার্থে সেনাবাহিনী পাল্টা গুলি চালায়। উক্ত গোলাগুলির ঘটনায় ৩ জন নিহত এবং কয়েকজন আহত হয় বলে জানা যায়।”
বৃহস্পতিবার রাত ১০টা থেকে ১১টার দিকে সদর এলাকায় গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে বলে জানায় স্থানীয়রা।
আহতদের মধ্যে চারজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে এবং বর্তমানে পাঁচজন ভর্তি আছেন বলে জানান খাগড়াছড়ি জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক কর্মকর্তা রিপল বাপ্পী চাকমা।
তিনি বলেন, সন্ধ্যার পর থেকে একের পর এক আহত ব্যক্তিরা হাসপাতালে ভর্তি হন।
দীঘিনালায় সহিংসতায় সাতজন আহত হয়েছে বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে দুইজনকে চট্টগ্রাম মেডিক্যালে পাঠানো হয়েছে, এদের একজন পাহাড়ি এবং অন্যজন বাঙালি।
তবে বৃহস্পতিবারের চেয়ে শুক্রবার পরিস্থিতি শান্ত বলে জানান ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা মি. হক।
“পুলিশ এবং সেনাবাহিনী গতকাল বিকেল থেকে এখনও পর্যন্ত ওখানে উপস্থিত আছে এবং গতকাল রাত আটটার মধ্যে আমরা সব কন্ট্রোল করে ফেলছি। লোকাল গাড়ি চলছে।”
তবে স্থানীয় সাংবাদিকরা বলছেন, আতঙ্ক ও গুজব মিলিয়ে সেখানকার পরিস্থিতি এখনও বেশ থমথমে।
মানবাধিকার কর্মী ত্রিরতন চাকমা জানান, পাহাড়ে এখনও উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজমান রয়েছে। মূল সড়কে অবস্থান নিতে দেখা গেছে সেনাবাহিনী ও বিজিবিকে।
মতামত দিন