🇧🇩 বাংলাদেশে বাড়ছে ভূমিকম্পের ঝুঁকি, ছোট কম্পনেই বড় সতর্কতা — জনগণকে প্রস্তুতির আহ্বান

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কয়েক সপ্তাহে একের পর এক হালকা ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। দিনের পর দিন রাতের গভীরেও ঘর কেঁপে ওঠার অনুভূতি হওয়ায় পরিবারের সবাই দুশ্চিন্তায় সময় কাটাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন—এগুলো ভয় পাওয়ার জন্য নয়, বরং সচেতন হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংকেত।

সাম্প্রতিক ঘটনার বিবরণ

গত ২১ নভেম্বর রাতে রাজধানী ঢাকা, নরসিংদী, গাজীপুর ও আশপাশের জেলাগুলোতে কয়েক সেকেন্ডের দোলা অনুভূত হয়। অনেকে ঘুম থেকে লাফিয়ে নেমে আসে, কেউ আবার বাচ্চাদের কোলে নিয়ে রাস্তায় ছুটে যায়। মিরপুরের এক বাসিন্দা বলেন—“মনে হচ্ছিল ঘরটা দুলছে। প্রথমে মাথা ঘোরার মতো লাগলেও পরে বুঝলাম ভূমিকম্প।”

এর আগের দিন সিলেট, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারেও একইভাবে কাঁপুনি অনুভূত হয়। সিলেটের জিন্দাবাজার এলাকার এক দোকানদার জানান, “হঠাৎ কাচপ্লেট শব্দ করল। সবাই দোকান ফেলে রাস্তায় বের হয়ে এলাম।”

কেন বাড়ছে কম্পন

বাংলাদেশ সক্রিয় টেকটোনিক জোনে অবস্থান করায় নিয়মিত ছোট-বড় কম্পন অনুভূত হওয়া স্বাভাবিক, তবে বিশেষজ্ঞদের মতে গত বছর থেকে কম্পনের সংখ্যা ও মাত্রা উভয়ই বেড়েছে। দেশের নিচ দিয়ে চলে গেছে Dauki Fault, Madhupur Fault এবং পূর্বদিকে Indo–Burma Subduction Zone—যা প্রতিনিয়ত ভূগর্ভে চাপ তৈরি করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিদেরা বলছেন, ভূগর্ভে দীর্ঘদিনের জমে থাকা চাপ একবারে মুক্তি পেলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে অস্বাভাবিকতা

ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ না হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাজ্য গত দুই বছরে একাধিক মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প অনুভব করেছে। ইংল্যান্ডের নটিংহ্যামে ২০২৪ সালে ৪.২ মাত্রার ভূমিকম্পে ঘরের দেয়ালে ফাটল দেখা যায়, মানুষ ভয়ে বাইরে ছুটে আসে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন—বিশ্বব্যাপী প্লেট মুভমেন্ট বেড়ে যাওয়ায় এমন অস্বাভাবিক কম্পন আরও বাড়তে পারে।

কেন বাংলাদেশে বিপদের মাত্রা বেশি

বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি কেবল ভূ-পৃষ্ঠগত কারণেই নয়, বরং ঘনবসতি ও দুর্বল নির্মাণ এ ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ঢাকার অধিকাংশ পুরনো ভবন দুর্বল ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। সংকীর্ণ রাস্তা, অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জামের সীমাবদ্ধতা এবং অবৈধ নির্মাণ বড় ধরনের ভূমিকম্পে বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি করে। বিশেষজ্ঞদের মতে—ঢাকায় ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে অল্প সময়েই অনেক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

ভূমিকম্প হলে কী করবেন

কম্পনের সময় দৌড়াবেন না। মাথা ও ঘাড় শক্ত কিছুর নিচে দিয়ে ঢেকে রাখুন। ডেস্ক, টেবিল বা শক্ত ফার্নিচারের নিচে আশ্রয় নিন। লিফট ব্যবহার করবেন না—সিঁড়ি সবচেয়ে নিরাপদ। বাইরে থাকলে বিল্ডিং, গাছ বা বিদ্যুতের খুঁটির নিচে দাঁড়াবেন না।

বাচ্চাদের “ডাক–কভার–হোল্ড” নিয়ম শিখিয়ে রাখা জরুরি। ঘরে ইমার্জেন্সি ব্যাগ রাখুন—টর্চ, বোতলজাত পানি, প্রাথমিক চিকিৎসা সামগ্রী ও জরুরি যোগাযোগের লিস্টসহ।

সরকার ও জনগণের যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভূমিকম্প থামানো সম্ভব নয়—কিন্তু ক্ষতি অনেক কমানো যায়। এজন্য প্রয়োজন নিরাপদ ভবন নির্মাণ, নিয়ম মানা, নিয়মিত ভবন পরিদর্শন ও জনগণকে প্রশিক্ষণ দেওয়া।

স্কুল, হাসপাতাল, অফিস—সবার জন্য আলাদা ইমার্জেন্সি প্ল্যান থাকা উচিত। পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের দ্রুত পরিদর্শন এখন সময়ের দাবি।

উপসংহার: ভয় নয়, প্রস্তুতিই সুরক্ষা

ভূমিকম্পের আতঙ্ক আমাদের জীবন থামিয়ে দিতে পারে না, কিন্তু প্রস্তুতি জীবন বাঁচাতে পারে। বাংলাদেশ যেহেতু ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা—তাই প্রতিটি পরিবার, প্রতিটি ভবন, প্রতিটি নাগরিককে এখন থেকেই সচেতন হতে হবে।

বিপদ এলে আতঙ্ক নয়—জ্ঞান, প্রস্তুতি ও ধৈর্যই সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা।

কলাম লেখিকা: সায়মা আনিকা