• ২০২৫ ডিসেম্বর ৩১, বুধবার, ১৪৩২ পৌষ ১৬
  • সর্বশেষ আপডেট : ১২:১২ পূর্বাহ্ন
English
পরিচালনাপর্ষদ
আমাদের সাথে থাকুন আপনি ও ... www.timebanglanews.com

খালেদা জিয়া:সংকট সংগ্রাম ও গণতন্ত্রের এক অধ্যায়।

  • প্রকাশিত ০১:১২ পূর্বাহ্ন বুধবার, ডিসেম্বর ৩১, ২০২৫
খালেদা জিয়া:সংকট সংগ্রাম ও গণতন্ত্রের এক অধ্যায়।
file
কামরুজ্জামান সুমন

 ইতিহাসে কিছু ব্যক্তিত্ব আছেন, যাঁদের উত্থান কেবল ক্ষমতার পালাবদল নয়, বরং সময়ের বাস্তবতা ও সমাজের গভীর প্রবণতার প্রতিফলন। খালেদা জিয়া তেমনই একজন চরিত্র। তিনি কোনো দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে আসেননি, বরং ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি, রাষ্ট্রীয় সংকট এবং দলীয় শূন্যতার সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে রাজনীতির মূল স্রোতে প্রবেশ করেন। 

১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর যিনি একজন গৃহবধূ হিসেবে পরিচিত ছিলেন, সময়ের ব্যবধানে তিনিই হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী এবং একটানা আট বছর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতৃত্ব। এই রূপান্তর কেবল ব্যক্তিগত নয়; এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামো, ক্ষমতার লড়াই এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

শূন্য নেতৃত্ব ও খালেদা জিয়ার আবির্ভাব

জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপি হঠাৎ করেই নেতৃত্বসংকটে পড়ে। দলটি তখন সাংগঠনিকভাবে বড় হলেও রাজনৈতিকভাবে দিশাহারা। রাষ্ট্রক্ষমতায় সামরিক হস্তক্ষেপ, বিচারপতি আবদুস সাত্তারের দুর্বলতা এবং অভ্যন্তরীণ বিভাজন সব মিলিয়ে বিএনপির অস্তিত্বই প্রশ্নের মুখে পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে খালেদা জিয়ার আবির্ভাবকে কেবল ‘উত্তরাধিকার’ হিসেবে দেখলে বিষয়টি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বাস্তবে তিনি ছিলেন একটি আপাত-নিরপেক্ষ মুখ, যিনি দলের ভেতরের বিভিন্ন ধারা ও স্বার্থকে সাময়িকভাবে হলেও একত্র করতে পেরেছিলেন।

রাজনীতিতে তার অনভিজ্ঞতাই এক অর্থে তাকে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। তিনি কোনো গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছিলেন না, বরং হয়ে উঠেছিলেন দলীয় ঐক্যের প্রতীক। পুরুষশাসিত রাজনীতিতে একজন বিধবা নারীর নেতৃত্ব গ্রহণ তখন ছিল ব্যতিক্রমী, যা বিএনপির জন্য নতুন শক্তিও তৈরি করে।

সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম

এরশাদের সামরিক শাসনামল ছিল বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য একটি গভীর সংকটকাল। এই সময়ে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ভূমিকা কেবল দলীয় নয়, বরং বৃহত্তর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অংশ হয়ে ওঠে। ৭ দলীয় জোট গঠন, রাজপথে ধারাবাহিক কর্মসূচি এবং আপসহীন অবস্থান সব মিলিয়ে তিনি ধীরে ধীরে একটি আন্দোলননির্ভর নেত্রী হিসেবে পরিচিতি পান।

এই সংগ্রাম সহজ ছিল না। একাধিকবার গ্রেপ্তার, দলীয় ভাঙন এবং বিরোধী দলগুলোর কৌশলগত সিদ্ধান্ত আন্দোলনকে দুর্বল করেছে। তবু দীর্ঘ আট বছরের রাজপথের রাজনীতি খালেদা জিয়াকে একটি প্রতীকী অবস্থানে নিয়ে যায়। ‘আপসহীন’ নেত্রীর পরিচয়টি তখন কেবল স্লোগান নয়; এটি তার রাজনৈতিক কৌশলেরই প্রতিফলন।

ক্ষমতায় যাত্রা ও নারীর নেতৃত্বের তাৎপর্য

১৯৯১ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রী হওয়া ছিল একাধিক অর্থে ঐতিহাসিক। একদিকে এটি ছিল সামরিক শাসনের পর গণতান্ত্রিক শাসনে প্রত্যাবর্তন, অন্যদিকে মুসলিম বিশ্বের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার আবির্ভাব সমাজে নারীর নেতৃত্বের নতুন সম্ভাবনা তৈরি করে।

তবে এই অর্জন কেবল ব্যক্তিগত নয়। এটি দেখায়, বাংলাদেশে রাজনৈতিক বৈধতা কেবল সামরিক বা উত্তরাধিকারসূত্রে নয়, গণআন্দোলন ও নির্বাচনের মাধ্যমেও অর্জিত হতে পারে। একই সঙ্গে এটি প্রশ্ন তোলে নারীর ক্ষমতায়ন কি ব্যক্তিকেন্দ্রিক নাকি প্রাতিষ্ঠানিক? খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে দেখা যায়, নারী নেতৃত্বের এই অগ্রগতি ব্যক্তি ছাড়িয়ে দল বা রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে স্থায়ীভাবে প্রতিফলিত হয়নি।

নির্বাচনী জনপ্রিয়তা ও রাজনৈতিক শক্তি

খালেদা জিয়ার নির্বাচনী রেকর্ড নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী। একাধিক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কখনো পরাজিত না হওয়া দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে বিরল। এটি তার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার প্রমাণ হলেও একই সঙ্গে দলীয় কাঠামোর শক্তিও নির্দেশ করে। তবে নির্বাচনী সাফল্যই সব নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতির ধরন বদলেছে, এবং জনপ্রিয়তার রাজনীতি ধীরে ধীরে প্রাতিষ্ঠানিক সংকটে রূপ নিয়েছে যার প্রভাব পরবর্তী সময়ে বিএনপির ওপরও পড়েছে।

‘এক-এগারো’ ও রাজনীতির মোড় পরিবর্তন

২০০৭ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন খালেদা জিয়ার জীবনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ক্ষমতা হারানো, গ্রেপ্তার এবং দীর্ঘ রাজনৈতিক নিঃসঙ্গতা তার নেতৃত্বকে সীমাবদ্ধ করে দেয়। এখানে ব্যক্তিগত দৃঢ়তার পাশাপাশি রাজনীতির কাঠামোগত বাস্তবতাও স্পষ্ট হয় ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেতৃত্ব সংকটে পড়লে দলও দুর্বল হয়ে যায়। এই সময়টি দেখিয়ে দেয়, আন্দোলননির্ভর রাজনীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের মধ্যে ভারসাম্য না থাকলে নেতৃত্ব টেকসই হয় না।

খালেদা জিয়া: ব্যক্তি, প্রতীক ও সীমাবদ্ধতা

খালেদা জিয়া একদিকে গণতন্ত্রের সংগ্রামের প্রতীক, অন্যদিকে বাংলাদেশের রাজনীতির সীমাবদ্ধতারও প্রতিচ্ছবি। তিনি যেমন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মুখ, তেমনি তার নেতৃত্বও ব্যক্তি-নির্ভর কাঠামোর বাইরে যেতে পারেনি। ‘দেশনেত্রী’ সম্বোধন জনপ্রিয়তা তৈরি করেছে, কিন্তু তা দলীয় গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করেনি এই প্রশ্নটি আজও প্রাসঙ্গিক।

পরিশেষে, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক যাত্রা আমাদের শেখায়, সংকটের মধ্যেও নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। তবে একই সঙ্গে এটি সতর্ক করে ব্যক্তিগত দৃঢ়তা ও জনপ্রিয়তা দীর্ঘমেয়াদে গণতন্ত্রের বিকল্প হতে পারে না। আজ যখন বাংলাদেশ নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি, তখন খালেদা জিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে প্রশ্ন ওঠে: রাজনৈতিক দলগুলো কি ব্যক্তি-নির্ভরতা ছাড়িয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি গড়ে তুলতে পারবে? গণতন্ত্র কি কেবল আন্দোলনের মাধ্যমে নয়, নিয়মতান্ত্রিক সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে টেকসই হবে?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তরই নির্ধারণ করবে, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার ইতিহাসে কেবল একটি অধ্যায় হয়ে থাকবে, নাকি ভবিষ্যতের জন্য একটি কার্যকর শিক্ষা হয়ে উঠবে।

    কামরুজ্জামান সুমন 

বিশেষ প্রতিনিধি, টাইম বাংলা নিউজ

সর্বশেষ