• ২০২৪ নভেম্বর ২১, বৃহস্পতিবার, ১৪৩১ অগ্রহায়ণ ৭
  • সর্বশেষ আপডেট : ০৮:১১ অপরাহ্ন
English
পরিচালনাপর্ষদ
আমাদের সাথে থাকুন আপনি ও ... www.timebanglanews.com

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে কেঁচো চাষে মানুনের ভাগ্য বদল, পাশ্ববর্তী যুবকরাও খামার গড়তে হচ্ছে আগ্রহী

  • প্রকাশিত ০৯:১১ অপরাহ্ন বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১, ২০২৪
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে কেঁচো চাষে মানুনের ভাগ্য বদল, পাশ্ববর্তী যুবকরাও খামার গড়তে হচ্ছে আগ্রহী
তরুণ উদ্যোক্তা মামুনের কেঁচো খামার
মোঃ আব্দুল কাদের, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিঃ


৪ হাজার টাকা পুঁজিতে এখন মাসিক আয় ৩০ হাজার টাকা

মোঃ আব্দুল কাদের(কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি)ঃ


কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলায় কেঁচো চাষ করে সফলতা পেয়েছেন মামুনুর রশীদ মামুন নামের এক তরুণ। উপজেলার রায়গঞ্জ ইউনিয়নের এই তরুণ খুব অল্প পুঁজি কাজে লাগিয়ে সফল হয়েছেন। ২০২০ সালের আগস্ট মাসে তিনি মাত্র চার হাজার টাকা দিয়ে ৬টি রিং এবং ১.৫ কেজি কেঁচো নিয়ে তার খামারের যাত্রা শুরু করেন। বর্তমানে তার খামারের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৭২ টন। 

সারেজমিনে গিয়ে দেখা যায় স্ব-পরিবারে খামারে কাজ করছেন মামুন। তিনি জানান, শিক্ষা জীবনে তিনি কুড়িগ্রামের একটি বেসরকারি ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করেছেন। এরপর ঢাকায় গিয়ে বিভিন্ন কন্সট্রাকশন কোম্পানিতে চাকুরীও করেছেন। ২০২০ সালের শুরুতেই পারিবারিক সমস্যার কারণে চাকরি ছেড়ে বাড়ি ফিরে আসেন। কিন্তু পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হিসেবে তার উপার্জন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কিছুদিনের মধ্যেই প্রচন্ডরকম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন তিনি। পরবর্তীতে জৈব কৃষি বিস্তারের লক্ষ্যে কাজ করা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান 'অদম্য কৃষি'র পরামর্শে একটি পরিত্যক্ত ঘরে কেঁচোর খামার শুরু করেন তিনি। শুরুতেই তিনি মাত্র চার হাজার টাকা বিনিয়োগ করে ৬ টি রিং এবং রংপুরের পীরগঞ্জ থেকে আনা ১.৫ কেজি কেঁচো দিয়ে উৎপাদন শুরু করেন। খামারের নাম দেন ক্রিয়েশনস্। পাশাপাশি ফেসবুকের মাধ্যমে তার নিজস্ব উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান 'ক্রিয়েশনস্ বিজনেস'র অনলাইন মার্কেটিং শুরু করেন।

বর্তমানে তিনি সেই খামারেই ২৪ টি রিং বসিয়েছেন এবং আরো ১০ শতক জায়গায় নতুন শেড তৈরী করেছেন। সেখানেও বসিয়েছেন ৩৬ টি রিং। বাকি জায়গায় স্তুপ প্রক্রিয়ায় উৎপাদন করছেন কেঁচো কম্পোস্ট বা ভার্মিকম্পোস্ট। 

দুই খামার মিলে প্রতিমাসে প্রায় ৬ টন জৈব সার উৎপাদন করেন বলে জানান তিনি। উৎপাদনশীলতার দিক থেকে এখন পর্যন্ত কুড়িগ্রাম জেলার সবচেয়ে বড় কেঁচো খামার ক্রিয়েশনস্ কেঁচো খামার নামের এই প্রতিষ্ঠানটি।

ভার্মিকম্পোস্ট তৈরী করতে তিনি গ্যাস মুক্ত বাসী গোবর, কলাগাছ কুচি ও কেঁচো ব্যবহার করে থাকেন।

মামুন বলেন, অত্যন্ত উপকারী হওয়ায় এই সারের চাহিদা প্রচুর। দ্রুত বিক্রি হয়। স্টক করে রাখার প্রয়োজন হয় না। প্রতি কেজি কেঁচো সার খুচরা ২০-২৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। পাইকারি ১০-১৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় এই কেঁচো সার। 

তিনি আরও বলেন, সার বিক্রি করে প্রতিমাসে আমার প্রায় ৩০ হাজার টাকা মুনাফা আসে। এছাড়া কেঁচোও বিক্রি হয়। আগের থেকে ভালো অবস্থানে আছি। আমার আর ঢাকায় গিয়ে চাকরি করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।

ছেলের সাফল্য নিয়ে কথা হয় মামুনের মা মর্জিনা বেগমের সাথে। তিনি জানান, একসময় খুবই অসহায় জীবন যাপন করেছি। তারপর ছেলে কেঁচোর খামার শুরু করে। এখন আমরা স্বাবলম্বী হতে পেরেছি। এই খামারের আয় দিয়েই আমাদের সংসার চলে।

মামুনের বড় বোন শারমিন আক্তার নিজেও একজন উদ্দোক্তা। অন্যের জমি লিজ নিয়ে গাছের চারা উৎপাদন করেন তিনি। মামুনুর রশীদের খামার থেকে ভার্মি কিনে চারা উৎপাদন করেন তিনি। তিনি জানান, মামুনের থেকে কেঁচো সার কিনে নার্সারিতে ব্যবহার করছি। বীজ থেকে অঙ্কুরোদগম হার দারুন। এই সার ব্যবহার করে সুস্থ-সবল, রোগব্যাধিমুক্ত চারা উৎপাদন করছি। ফলে গ্রাহকের চাহিদাও বেড়েছে। আর আগের থেকে বেশি লাভবান হচ্ছি।

স্থানীয় কৃষক লালমিয়া জানান, মামুন শুরুতে ঘরের ভেতর গোবর দিয়ে কি করছে আমরা বুঝিই নাই। পরে দেখি ধীরে ধীরে বড় হইল খামার। এখন আমি নিজেই এই সার কিনি। বাইরে থেকে গাড়ি এসে নিয়ে যায়। দোকানদারেরাও কেনে। মামুন ভালই করছে। চাকরি খোঁজার চেয়ে এমন কিছু করাই ভাল।

স্থানীয় সার ও কীটনাশক ব্যবসায়ী রাশিদুল ইসলাম জানান, মামুনের খামার থেকে ভার্মিকম্পোস্ট কিনে বিক্রি করি। এই সার সবধরনের ফসলে ব্যবহার করা হচ্ছে। ধানক্ষেতে এই সার দিলে রাসায়নিক সার কম ব্যবহার করলেই চলে। তাই এই সারের প্রচুর চাহিদা দেখা যায়।

মামুনুর রশীদের কেঁচো খামারের সাফল্য দেখে এলাকার অনেকেই কেঁচো খামার করতে উদ্যোগী হয়েছেন। তেমনই একজন ইউনিয়নের রতনপুর গ্রামের আপেল মাহমুদ। কথা হয় আপেলের চাচা আনোয়ার হকের সাথে। তিনি জানান, মামুনের পরামর্শে তার ভাতিজাও কেঁচো খামার শুরু করেছে। প্রথমে ২টি রিংয়ে শুরু করলেও এখন তার ৫ টি রিংয়ে কেঁচো এবং সার উৎপাদন হচ্ছে। আরও অনেকে এটা করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে।

কিন্তু এই সার উৎপাদন কিভাবে শিখলেন জানতে চাইলে মামুন জানান, ২০১৬ সালে নাগেশ্বরী উপজেলা যুব উন্নয়ন অফিসার মনজুর আলম স্যার আমাকে গবাদিপশু, হাঁস-মুরগী পালন, প্রাথমিক চিকিৎসা, মৎস্য চাষ ও কৃষি বিষয়ক তিনমাস ব্যাপী প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেন। সেখানে ভার্মিকম্পোস্ট সহ বিভিন্ন ধরনের জৈব সার তৈরীর উপর ক্লাস ছিল। যদিও তখন এটা নিয়ে কাজ করা হয়নি। পরবর্তীতে ২০২০ সালে অদম্য কৃষি থেকে এটা করার পরামর্শ পাই। এছাড়াও বাংলাদেশ ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদক এসোসিয়েশন ও নিজের বলার মত একটা গল্প ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে আমি এই সারের উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজার তৈরী এবং বাজারজাতকরণ সংশ্লিষ্ট অনেক শিক্ষা ও সহযোগিতা পাই। 

এ বিষয়ে উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা জনাব মনজুর আলম বলেন, আমি তার খামার পরিদর্শন করেছি। সে কেঁচো সার উৎপাদন করছে। কেঁচো সার উৎপাদনে তার সফলতা আশপাশের যুবকদের উদ্যমী হতে অনুপ্রাণিত করবে।

উপজেলা কৃষি অফিসার জনাব মোঃ শাহরিয়ার হোসেন বলেন, এই সারটি আসলে মাটির প্রাণ। বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনে এই সারের বিকল্প নেই। আমি কৃষি বিভাগ থেকে সর্বদা তার পাশে আছি। সবসময় পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। তার উৎপাদিত কেঁচো সার কিভাবে সঠিকভাবে বাজারজাত করা যায়, কিভাবে তাকে আরও লাভবান করা যায়, আমরা সেই পরিকল্পনা করছি।

উল্লেখ্য, গত ২৮ অক্টোবর ২০২১ ইং তারিখে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আয়োজিত মুজিব শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে 'শত কৃষকের সম্মাননা' অনুষ্ঠানে ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদনে সফলতার জন্য মামুনুর রশিদ মামুনকেও সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়।

সর্বশেষ