রিপোর্টার, অলোক
স্টিফেন হকিং এক বক্তব্যে বলেছিলেন যে, বিজ্ঞানে একসময় সময় ভ্রমণ নিয়ে চিন্তার চর্চা ছিল না। আমিও এ নিয়ে কথাবার্তা বলতাম না খুব একটা। পাছে না আবার পাগলের খেতাব পাই। কিন্তু এখন আর সেই ভয় নেই। এখন একটা টাইম মেশিন পেলে আমি দেখে আসবো সেই মুহুর্তটি, যখন গ্যালিলিও আকাশের দিকে তাক করেছিল টেলিস্কোপখানা৷ কিংবা চলে যাবো মহা বিশ্বের শেষ প্রান্তে। দেখে আসব, কিভাবে ইতি ঘটবে এ মহাবিশ্বের।
সময় ভ্রমণ কী সম্ভব সেটা বুঝতে হলে পদার্থবিদের মতো চিন্তা করতে হবে। হ্যাঁ, বলছি চতুর্থ মাত্রার কথা। বিষয়টাকে একটু কঠিন মনে হলেও আসলে তা নয়। একটি ছোট্ট বাচ্চাও জানে, প্রতিটি বস্তুই ত্রিমাত্রিক স্থানে অবস্থান করে। এই যে আমিও। সবকিছুরই আছে দৈর্ঘ্য প্রস্থ,উচ্চতা। দৈর্ঘ্য আছে অনেক ধরনের। একজন মানুষ হয়তো ৮০ বছর বাঁচতে পারেন। আবার স্টোনহেঞ্জের পাথর গুলো দাড়িয়ে আছে হাজার হাজার বছর ধরে। আমাদের সৌরজগত থাকবে আরও কয়েক শ কোটি বছর। ফলে সবকিছুর দৈর্ঘস্থানের দিকে যেমন আছে,তেমনি আছে সময়ের দিকেও। তাই সময় ভ্রমণের মানে হলো এই চতুর্থ মাত্রা দিয়ে চলাচল।
ধরুন, আপনি একটি রাস্তা ধরে সোজাসুজি চলছেন এটা হলো একমাত্রিক চলাচল। ডানে বা বাঁয়ে ঘুরলে সঙ্গে আরেকটি মাত্রা যোগ হবে। পথটা পাহাড়ি হলে একটু ওপরে উঠলে বা নিচে নামলেই যোগ হবে আরও একটি মাত্রা। কিন্তু সময়-মাত্রাটি ব্যবহার করে কীভাবে সামনে পেছনে আসা যায় ? চলচ্চিত্রে অনেক সময় টাইম মেশিন দেখানো হয়, যেটাই চেপে বসলেই সময় সুড়ঙ্গ পার হয়ে চলে যায় অতীত বা ভবিষ্যতে। বুদ্ধিটা একেবারে খারাপ না। সময় সুড়ঙ্গের কথা ভাবছেন বিঞ্জানিরাও। নাম ওয়ার্মহোল। কিন্তু অনেক অনেক ক্ষুদ্র। এত ক্ষুদ্র যে খালি চোখে দেখা প্রশ্নই ওঠে না !
জগতের কোন কিছুই মসৃণ নয়। সবচেয়ে মসৃণ বস্তুটাও কিছু ভাঁজ আছেই। একই কথা খাটে সময়ের জন্যেও অণু ও পরমানুর চেয়েও ক্ষুদ্রমাপকাটিতে কোয়ান্টাম ফোম নামে একটি জায়গা আছে। ওয়ার্মহোলের অস্তিত্ব এখানেই। এই কোয়ান্টাম জগতে স্থান কালের মধ্যে দিয়ে অবিরত তৈরি ও ধ্বংস হয় সুড়ঙ্গ। এরা যুক্ত করে দুটি আলাদা স্থান ও সময়কে। কিন্তু সমস্যা হলো, এই সুড়ঙ্গ ১ সেন্টিমিটারের ১ লক্ষ কোটি কোটি কোটি ভাগের এক ভাগ পরিমান চওড়া। তাহলে পার হওয়ার উপাই ? কিছু কিছু বিজ্ঞানি বিশ্বাস করেন, কোন ভাবে একটি ওয়ার্মহোলকে পাকড়াও করে হয়তো মানুষের পারাপারের মতো বড় করে তোলা যাবে। হয়ত তার একমুখ থাকবে পৃথিবীতে, আরেক মুখ বহু বহু দুরের কোন গ্রহ বা দুরের কোন অতীত বা ভবিষ্যতে।
কিন্তু সময় ভ্রমণ একটি সমস্যা হলো প্যারাডাক্স বা স্ববিরোধিতা। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত নাম গ্রান্ডফাদার প্যারাডাক্স। এটাকে একটু সরল করে অন্যভাবে বলি। নাম দিলাম ম্যাড সায়েন্টিস্ট প্যারাডাক্স। মনে করুণ আমি একটি সময় সুড়ঙ্গ বানালাম, যা মাত্র এক মিনিট লম্বা। এটায় চোখ রেখে পাগল বিঞ্জানি নিজের এক মিনিট আগের চেহারা দেখছেন। কিন্তু তিনি যদি সুড়ঙ্গের ওপারের চেহারায় গুলি করেন তাহলে কী হবে ? তিনি তা হলে এক মিনিট আগে মারা গেলেন। তাহলে গুলিটা কে মারল !!
এধরনের টাইম মেশিন মহাবিশ্বের মৌলিক একটি নীতির বিরুদ্ধে যায়। ফলাফল আগে ঘটে। কখনোই উল্টোটা নয়। তা না হলে মহাবিশ্ব হতো বিশৃঙ্খল। ফলে আমার বিশ্বাস কোনো না কোনভাবে বিজ্ঞানি নিজেকে গুলি করতে ব্যর্থ হবেনই৷ তা ছাড়া ওয়ার্মহলো বেশিক্ষণ টিকেও থাকতে পারবে বলপ মনে হয় না। ধরুন, একটি স্পিকার দিয়ে গান বাজছে। তার দিয়ে মাইক যুক্ত করে শব্দ বাড়ানো হলো। মাইকের সামনে যদি স্পিকার রাখা হয় তাহলে কী হবে ? প্রতিবার ঘুরে এসে শব্দ ক্রমশ বাড়তে থাকবে। কেউ না থামিয়ে দিলে একসময় পুরো সাউন্ড সিস্টেম ভেঙ্গে পড়বে। একই ঘটনা ঘটবে ওয়ার্মহলের ক্ষেত্রেও তবে এখানে শব্দের বদলে কাজ করবে বিকিরণ। ওয়ার্মহোলের মুখ খুলতে না খুলতেই এতে বিকিরণ প্রবেশ করবে এবং লুপ আকারে ঘুরবে। একসময় এর শক্তি এত বাড়বে যে এটি ধ্বংস হয়ে যাবে। অর্থাৎ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সময় সুড়ঙ্গগুলো দিয়ে বাস্তবে কাজ হবে না।
তবে সময় ভ্রমণ করে ভবিষ্যতে যাওয়ার আরেকটি উপায় আছে। সময় প্রবাহিত হয় নদীর মতো। অবিরত। তবে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে প্রবাহের গতি আলাদা। ১০০ বছর আগে কথাটা প্রথম বলেছিলেন আইনস্টাইন। কথাটার প্রমাণ আছে আমাদের হাতের নাগালেই। আমরা বর্তমানে হরদম জিপিএস ব্যবহার করি । এটি কাজ করে উপগ্রহের মাধ্যমে। উপগ্রহে আছে খুব নিখুঁত ঘড়ি। কিন্তু শত ভাগ নয়। পৃথিবীর তুলনায় উপগ্রহের ঘড়ি প্রতিদিন এক সেকেন্ডের এক শ কোটি ভাগের এক ভাগ দ্রুত চলে। এটাকে হিসাবে না ধরলে জিপিএসের নির্দেশনা হবে ভুল। ওই ঘড়িগুলো দ্রুত চলে কারণ পৃথিবীর তুলনায় মহাশূন্যে সময় দ্রুত চলে। এরবকারণ পৃথিবীর ভর। একটি বস্তু যত ভারী হয়, সেটি তত বেশি ধীর করে দেয় সময়কে। এর ফলেই উন্মুক্ত হয়েছে সময় ভ্রমনের আরেকটি সম্ভবনা।
আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে রয়েছে গ্যালাক্সির সবচেয়ে ভারি বস্তুগুলো। রয়েছে একটি সুপারম্যাসিভ বা অতিভারী কৃষ্ণগহ্বর (ব্লাকহোল)। ভর চল্লিশ লক্ষ সূর্যের সমান, যে ভর কেন্দ্রিভুত আছে একটি মাত্র বিন্দুতে। এর খুব কাছ থেকে আলোও বের হতে পারে না। সময়কে সবচেয়ে বেশি বিকৃত করে কৃষ্ণগহব্বর। তৈরি করে প্রকৃত টাইম মেশিন।
মনে করুন, কেউ মহাকাশ যানে চেপে কৃষ্ণগহ্বর ভ্রমণে গেলেন। পৃথিবী থেকে দেখা যাচ্ছে প্রতি ১৬ মিনিটে একবার তিনি প্রদক্ষিণ করছেন। কিন্তু নভোচারী প্রতি ১৬ মিনিটের বদলে অনুভব করছেন মাত্র ৮ মিনিট। ফলে কৃষ্ণগহ্বর থেকে দূরে অবস্থান করা কারও চেয়ে তিনি অনুভব করবেন অর্ধেকটা সময়। যানের নভোচারী সময় ভেদ করে চলতে থাকবেন। ধরুন, তিনি পাঁচ বছর এভাবে ঘুরলেন। ফিরে এসে দেখবেন, পৃথিবীতে পার হয়ে গেছে ১০ বছর। মানে পাঁচ বছর বেশি।
তার মানে অতিভারী কৃষ্ণগহ্বররা এক একটি টাইম মেশিন। এটি ওয়ার্মহোলের মতো প্যারাডক্সেরও জন্ম দেয় না। তবে ভাবনাটি পুরোপুরি বাস্তবসম্মত নয়। এবং খুব ভয়ংকর। তার ওপর এভাবে খুব বেশি দূর ভবিষ্যতে যাওয়াও যাবে না। তবে খুশির খবর হলো, উপায় আছে আরেকটিও। এর জব্য চলতে হবে অনেক অনেক বেশি বেগে। আমরা জানি,মহাবিশ্বে গতির একটি সর্বোচ্চ সূমা নির্ধারিত আছে। এটি হলো সেকেন্ডে ১৮৬০০০ মাইল,যার অপর নাম আলোর বেগ। কোন কিছুর বেগ এর চেয়ে বেশি হতে পারে না। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, এই বেগের কাছাকাছি বেগে চলতে পারলেও আপনি চলে যাবেন ভবিষ্যতে।
মনে করুন, পৃথিবীকে বেষ্টন করে গোল করে একটি রেলপথ তৈরি করা আছে। এর ওপর দিয়ে একটি দ্রুতট্রেন চলতে শুরু করল। বেগ আলোর বেগের খুব কাছাকাছি। ট্রেনটি একের পর এক চক্কর খেতে থাকবে পৃথিবীকে ঘীরে প্রায় সাতবার প্রতি সেকেন্ডে এবার ট্রেনের ভেতরে অদ্ভুত কান্ড ঘটতে শুরু করবে। বাইরের জগতের তুলনায় সময় প্রবাহিত হবপ ধীরে। যেমনটা ঘটেছিল কৃষ্ণগহ্বরের কাছে। তবে ট্রেনের বপগ বাড়িয়ে আলোর বেগের ওপর নেওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। কেউ একজন ট্রেনের ভেতরে দৌড়ানো শুরু করলে মিলিত বেগ কি কোন ভাবেই আলোর বেগের চেয়ে বেশি হওয়া সম্ভব নয় ? না। কারণ প্রকৃতির সূত্রমতে সময় এমন ভবে ধীর হয়ে যাবে যে বেগ আলোর বেগের নিচেই থাকবে।
ধরুন, ২০৫০ সালের ১ জানুয়ারি তারিখে ট্রেনটি ছেড়ে গেল। ১০০ বছর পরে, ২১৫০ সালের একই তারিখে শেষ হলো যাত্রা। কিন্তু ভেতরের যাত্রীদের সময় অতিবাহিত হবে মাত্র ১ সপ্তাহ। তাদের সময় এতটাই ধীরে চলছিলো যে ১ সপ্তাহেই বাইরের জগতে ১০০ বছর অতিবাহিত হয়ে গিয়েছিলো। তার মানপ, তারা চলে এসেছেন ভবিষ্যতের পৃথিবীতে। হ্যাঁ, এমন ট্রেন বানানো প্রায় অসম্ভব। তবে ইউরোপীয় গবেষণা সংস্থা সার্নে (CERN) কিন্তু এ ধরনের জিনিস আছে।
এখানে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কণা ত্বটকযন্ত্র। অবস্থান সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরের মাটির গভীরে। রয়েছে ১৬ মাইল লম্বা একটি বৃত্তাকার সুড়ঙ্গ। ট্রিলিয়ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা ছুটে চলে এই সুড়ঙ্গ ধরে। সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ের মধ্যে এদের বেগ শূণ্য থেকে ৬০ হাজার মাইলে উঠে যায়। আরও শক্তি দিলে এ বেগ এত বাড়ে যে কণিকাগুলো প্রতি সেকেন্ডে সুড়ঙ্গকে ১১ হাজার বার চক্কর খায়। যা আলোর বেগের খুব কাছাকাছি। এভাবে এরা আলোর ৯৯.৯৯ ভাগ পর্যন্ত বেগ অর্জন করতে পারে। এ সময় এরা শুধু স্থান ভেদ করেই চলে না। চলে সময় ভেদ করেও। আমরা সেটা জানলাম কী ভাবে ? পাই-মেসন নামে একধরনের কণা আছে। এমনিতে এরা এক সেকেন্ডের আড়াই হাজার কোটি সেকেন্ডের এক ভাগ সময়ের মধ্যে ভেঙে যায়। কিন্তু বেগ আলোর কাছাকাছি হলে এরা ভাঙতে সময় নেয় ৩০ গুণ বেশি সময়।
এ তো গেল কণিকা সময় ভ্রমণ। আমরা মানুষেরা তা কীভাবে করব ? আমার মনে হয়, মহাকাশে যাওয়া ছাড়া উপাই নেই। সবচেয়ে দ্রুতগামী মনুষ্যবাহী যানের নাম অ্যাপোলা ১০। বেগ ছিল ঘন্টায় ২৫ হাজার মাইল। কিন্তু সময় ভ্রমণের জন্য আরও ২ হাজার গুণেরও বেশি জোরে ছুটতে হবে। আলোর বেগের কাছাকাছি যেতে এর সময় লাগবে ৬ বছর। এক সপ্তাহের ভেতর এটি সৌরজগতের বহিস্থ গ্রহগুলো পার হয়ে যাবে। দুই বছরের মাথায় সৌরজগৎ পার। আরও দুই বছর পরে বেগ হবে আলোর ৯০ ভাগ। পৃথিবী থেকে ৩০ লক্ষ কোটি দূরে। সময় ভ্রমণও শুরু হয়ে যাবে এই সময়। পৃথিবীর দুই ঘন্টায় যানে এক ঘন্টা। যেমনটা হয়েছিল কৃষ্ণগহ্বরগামী যানের ক্ষেত্রে। আলোর ৯৯ ভাগ বেগ অর্জন করতে আর ২ বছর দরকার। এ অবস্থায় যানের একদিনে পৃথিবীতে এক বছর হয়ে যাবে। এবার সত্যিই ভবিষ্যতে চলে যাওয়া গেল।
সময়ের ধীরগতির আরেকটি ভালো দিক আছে। আমরা অনেক বড় বড় পথ পেরোতে পারব জীবদ্দশাতেই। যেমন আমাদের ছায়াপথের অপর প্রান্তে যেতে ৮০ বছর লাগবে। কতই না বিস্ময়কর এই জগৎ। যেখানে সময় ভিন্ন স্থানে ভিন্ন বেগে চলে। আমাদের চারপাশে লুকিয়ে থাকে ওয়ার্মহোল নামক সময়-সুড়ঙ্গ। পদার্থবিদ্যার জ্ঞান একদিন হয়তো সত্যিই আমাদের চতুর্থ মাত্রায় ভ্রমণ করাতে সক্ষম হবে বলে এমনটাই ধারণা বর্তমান বিজ্ঞানীদের।
মতামত দিন