দেশের প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ে সংঘটিত আগুনকে পরিকল্পিত বলে সন্দেহ করছেন রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। তারা বলছেন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও অনেক ঘটনার ধারাবাহিকতা সচিবালয়ের এই আগুন। তারা সরকার ও দেশবাসীকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন।
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া ঢাকাটাইমসের তথ্য বলছে, আগুনের ধরন ও অবস্থান এবং দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিস্থিতি এবং এর আগে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন দুটি তেলের জাহাজে আগুনের ঘটনা বিবেচনায় সচিবালয়ের অগ্নিকাণ্ডকে নাশকতা ছাড়া আর কিছু মনে করছেন না লোকজন। প্রকৃত ঘটনা জানতে দ্রুত তদন্তের দাবি জানান তারা।
রাজধানীর সচিবালয়ের মতো সুরক্ষিত এবং পর্যাপ্ত সুরক্ষা সরঞ্জামসজ্জিত জায়গায় আগুন লাগার ঘটনায় বিস্মিত মানুষ। সচিবালয়ে অফিস করতে আসা অনেক কর্মকর্তা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, সচিবালয়ে কোনো ধরনের বৈদ্যুতিক ত্রুটি থেকে একসঙ্গে ভবনের বিভিন্ন জায়গায় আগুন লাগবে এটা বিশ্বাস করেন না তারা।
এদিকে আগুন নেভানোর দায়িত্ব পালন করা নৌ-বাহিনীর সিনিয়র চিফ পেটি অফিসার (পিও) আমিনুল ইসলামও সন্দেহ করছেন পরিকল্পিত নাশকতার। তার সন্দেহের বিষয়ে তিনি বলেন, শর্ট সার্কিটের আগুন সাধারণত এক জায়গা থেকে শুরু হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আগুন একসঙ্গে বিভিন্ন স্থানে লেগেছে, যা অস্বাভাবিক। ছয়তলা, নয়তলা একসঙ্গে আগুন লাগে বলে জানান তিনি। সবকিছু চিহ্নিত করতে নৌ-বাহিনীর টিম কাজ করছে বলে জানান তিনি।
তিনটি জায়গা একসঙ্গে আগুন লাগার কথা নিশ্চিত করেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহেদ কামালও। তিনি বলেন, ‘আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি তিনটি জায়গায় একসঙ্গে আগুন দেখা গেছে।’
ঢাকাটাইমসের খবরে দেখা যায়, সচিবালয়ের পুড়ে যাওয়া সাত নম্বর ভবনের ছয়, সাত, আট ও নয়তলা পুড়েছে। ভবনটির পূর্ব ও পশ্চিম পাশে এবং মাঝবরাবর আগুনে পোড়া কালো ক্ষত হয়ে আছে। পূর্ব পাশে সাত ও আটতলায় কালো ক্ষতের চিহ্ন। এসব দেখে প্রত্যক্ষদর্শীরা একে পরিকল্পিত বলে মনে করছেন।
সচিবালয়ের ১২টি ভবনের মধ্যে এক নম্বর ভবনটি অগ্নিঝুঁকির তালিকায় ছিল। তবে সাত নম্বর ভবনটি ছিল সুরক্ষিত। সেখানে আগুন লাগার ঘটনা সন্দেহের উদ্রেক করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহও পরিকল্পিত নাশকতার দিকে ইঙ্গিত করেন। তিনি এসব নাশকতা ঘটতে পারার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের উদারতাকে দায়ী করেন। বলেন, ‘ফ্যাসিজমের এনাবলারদের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী সরকারের উদারতা দেখানোর পরিণাম এই কপালপোড়া জাতিকে অনন্তকাল ভোগাবে।…আজকে আমলা, আগামীকাল অন্য কেউ।’
সচিবালয়ের ওই সাত নম্বর ভবনে রয়েছে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি মন্ত্রণালয়ের দপ্তর। অন্তর্বর্তী সরকারের দুই তরুণ উপদেষ্টা নাহিদ হোসেন ও আসিফ মাহমুদের দপ্তরও এই ভবনে।
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ভূঁইয়া আগুনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তরুণ উপদেষ্টা ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘বিগত সময়ে হওয়া অর্থ লোপাট, দুর্নীতি নিয়ে আমরা কাজ করছিলাম। কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাটের প্রমাণও পাওয়া গিয়েছিল।’ তাদের ব্যর্থ করার জন্য এই ষড়যন্ত্র হতে পারে- এমনটা বলে হুঁশিয়ারি করেন তিনি।
বাংলাদেশ জাস্টিস পার্টির সভাপিত সৈয়দ জাভেদ মোহাম্মদ সালেহউদ্দিন সচিবালয়ে আগুনের ঘটনায় আমলাদের দিকে সন্দেহের আঙুল তোলেন। এ ঘটনাকে সুপরিকল্পিত বলে মন্তব্য করে তার আশঙ্কা, তাদের নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এসব নাশকতা চলতেই থাকবে।
জাস্টিস পার্টির সভাপতি বলেন, ‘বিগত ১৫-১৬ বছর যারা লুটপাট ছাড়া আর কিছুই করেনি, এখন বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ও সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ এদের বুকে কাঁপন ধরিয়েছে। তারা সাথী হিসাবে পেয়েছে লুটপাটের দোসরদের, দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদদের।’তিনি অবিলম্বে রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যবস্থা করতে আহ্বান জানান।
কদিন ধরে সচিবালয় ক্যাডার কর্মকর্তাদের একটা অংশের মধ্যে অস্থিরতা চলছে সংস্কার কমিশনের কয়েকটি প্রস্তাব নিয়ে। তারা সচিবালয়ের ভেতরে জমায়েত করেন এবং সংস্কার কমিশনের পদত্যাগ দাবি করেন। অথচ এ্ কমিশন ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গঠিত সরকারের সংস্কার পরিকল্পনার অংশ।
এদিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছিলেন, সচিবালয়ে আগুনের ঘটনায় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে বৃহস্পতিবার দুপুরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (জেলা ও মাঠপ্রশাসন) মোহাম্মদ খালেদ রহীমকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের কমিটি করা হয়।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর গত ৪ অক্টোবর রাত ১২টা ৫০ মিনিটে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) ‘বাংলার সৌরভ’নামের তেলের ট্যাংকারে আগুন লাগে। ৩০ সেপ্টেম্বর সকালে ১১টায় কর্ণফুলী নদীর ডলফিন জেটিতে ‘বাংলার জ্যোতি’নামে তেলবাহী জাহাজে বিস্ফোরণের পর আগুনে তিনজনের মৃত্যু হয়। বিএসসির বহরে তেলের ট্যাঙ্কার মাত্র এ দুটিই।
সচিবালয়ে আগুন লাগা সাততলা ভবনে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়; ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়; পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়; যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়; শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়সহ সরকারের আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর রয়েছে।
ঢাকার জেলা প্রশাসক তানভীর আহমেদের তথ্যমতে, বুধবার দিবাগত রাত পৌনে ২টার দিকে ওই ভবনে আগুন লাগে। তবে আগুন লাগার কারণ জানা যায়নি। আগুন লাগার কারণ ফায়ার সার্ভিসের বিশেষজ্ঞরা পরে বলতে পারবেন বলে জানান তিনি।
আগুন কীভাবে লেগেছে তা তদন্তের মাধ্যমে জানা যাবে বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহেদ কামাল। তিনি জানান, আগুন লাগার ছয় ঘণ্টা পর সকাল আটটা পাঁচ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে।
আগুন নেভানোর কাজে যোগ দিয়ে সড়কে ট্রাকের চাপায় মারা গেছেন ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মী। ওই ট্রাকচালককে আটক করা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক জানান, ফায়ার সার্ভিসের ২১১ জন কর্মী আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন। ফায়ার সার্ভিসের বড় গাড়িগুলো ভেতরে ঢোকানো যাচ্ছিল না। পরে গেট ভেঙে দুটি গাড়ি ঢোকানো হয়।
এদিকে সচিবালয়ের নিরাপত্তায় দুই প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের সংবাদের পরপরই সেনাবাহিনী এবং পুলিশ সদস্যরাও সচিবালয়ের গেটের সামনে কড়া পাহারায় রয়েছেন। সেখানকার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। শুধু পাঁচ ননম্বর গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের পরিদর্শক আনোয়ারুল ইসলাম জানান, তারা আগুন লাগার খবর পান বুধবার দিবাগত রাত ১টা ৫২ মিনিটে। ১টা ৫৪ মিনিটে ঘটনাস্থলে পৌঁছান ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
মতামত দিন