• ২০২৫ এপ্রিল ১৮, শুক্রবার, ১৪৩২ বৈশাখ ৪
  • সর্বশেষ আপডেট : ০১:০৪ পূর্বাহ্ন
English
পরিচালনাপর্ষদ
আমাদের সাথে থাকুন আপনি ও ... www.timebanglanews.com

প্রতিবাদের নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা- লুটপাট, পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছালো কীভাবে?

  • প্রকাশিত ০৪:০৪ পূর্বাহ্ন শুক্রবার, এপ্রিল ১৮, ২০২৫
প্রতিবাদের নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা- লুটপাট, পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছালো কীভাবে?
সংগৃহীত ছবি
নিজস্ব সংবাদদাতা

গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে আয়োজিত বিক্ষোভ মিছিল থেকে সোমবার বাংলাদেশের সিলেট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ বেশ কয়েকটি জেলায় কেএফসি, বাটা, পিৎজা হাটসহ এক ডজনেরও বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যে হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে, সেটি ঘিরে ব্যবসায়ীদের মধ্যে নতুন করে উদ্বেগ ও নিরাপত্তা শঙ্কা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনা হতেও দেখা যাচ্ছে।

বিশেষ করে, এমন একটি সময়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনাটি ঘটলো যখন বাংলাদেশে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অর্ন্তবর্তী সরকার ঢাকায় চার দিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলন শুরু করেছে এবং বিভিন্ন দেশের কয়েকশ বিনিয়োগকারী তাতে যোগ দিতে দেশটিতে অবস্থান করছেন।

ফলে হামলা ও লুটপাটের ঘটনা দেখার পর তারা সরকারের আহ্বানে কতটুকু সাড়া দেবেন, সেটি নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

এসব ঘটনায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যে নেতিবাচক বার্তা পেয়েছে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু তার চেয়েও লজ্জার এবং দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, দেশের ভেতরে বাজার ব্যবস্থাকে আমরা সুরক্ষা দিতে পারছি না। এটা ভীতিকর," সাংবাদিকদের বলছিলেন অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

যারা হামলার ঘটনা ঘটিয়েছেন, তারা দেশের অর্থনীতি ও স্থিতিশীলতার "প্রকৃত শত্রু" বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন। জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

ঘটনার পর পুলিশ প্রধানের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, হামলাকারীদের গ্রেফতারে অভিযান শুরু করেছেন তারা। ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে।

তবে পরিস্থিতি এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেটার পেছনে সরকারের দায় রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

"সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো এটার দায় এড়াতে পারে না। গত কয়েক মাসে একের পর এক মব বা সংঘবদ্ধ হয়ে হামলা ও লুটপাটের ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হলে এখন এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না," সাংবাদিকদের বলেন মানবাধিকারকর্মী নূর খান।

হামলাকারীদের বিষয়ে যা জানা যাচ্ছে

গাজায় গণহত্যার বিরুদ্ধে বের হওয়া বিক্ষোভ মিছিল থেকে সোমবার সিলেট, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, খুলনা, গাজীপুরসহ আরও কয়েকটি জেলায় হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন স্থানীয় সাংবাদিক ও পুলিশের কর্মকর্তারা।

এর মধ্যে সিলেট মহানগরের দরগা গেইট এলাকায় অবস্থিত বহুজাতিক জুতা কোম্পানি বাটা'র একটি শোরুমে হামলার পর লুটপাট চালানো হয়।

ওই ঘটনার একটি ভিডিও ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে একদল ব্যক্তি শোরুমে ঢুকে জুতা, মোজা, বেল্টসহ বিভিন্ন পণ্য লুট করে নিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে।

ওই ঘটনায় মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত ১৪ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে, গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ কেউ জুতা লুটের পর সেগুলো বিক্রি করার জন্য ফেসবুকে বিজ্ঞাপন পর্যন্ত দিয়েছিলেন।

"সেই সূত্র ধরেই প্রযুক্তির সহায়তায় তাদেরকে শনাক্ত করে আটক করা হয়েছে," সাংবাদিকদের বলেন সিলেট কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়াউল হক।

অন্যদিকে, খুলনা মহানগরীতেও সোমবার কেএফসি, ডোমিনোজ পিৎজা এবং বাটার একটি শোরুমে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ঘটনায় ৩১ জনকে গ্রেফতার করেছে স্থানীয় থানা পুলিশ।

গ্রেফতারকৃতদের বড় অংশই বয়সে তরুণ বলে জানিয়েছে পুলিশ। তারা নিজেদের ইচ্ছায়, নাকি কারও নির্দেশে হামলা-লুটপাট চালিয়েছেন, সেটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।

এছাড়া জড়িতদের গ্রেফতার এবং লুট হওয়ার মালামাল উদ্ধারে এখনও অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা।

প্রকাশ্যে হামলা ও লুটের ঘটনা ঘটছে কেন?

গণহত্যার মতো একটি অপরাধের প্রতিবাদে বের হওয়া বিক্ষোভ মিছিল থেকে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও লুটপাটের মতো আরেকটি অপরাধে জড়িয়ে পড়ার যে ঘটনা সোমবার বাংলাদেশে ঘটতে দেখা গেছে, সেটার জন্য সরকারকেই দুষছেন বিশ্লেষকরা।

"এর আগে মব সৃষ্টি করে বিভিন্ন স্থানে হামলা ও লুটপাটের যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোতে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের এক ধরনের নির্লিপ্ততা লক্ষ্য করা গেছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে সেভাবে শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি," সাংবাদিকদের বলছিলেন মানবাধিকারকর্মী নূর খান।

"ফলে দুষ্কৃতকারী বা অপরাধীরা ওই ধরনের ঘটনা পুনরায় ঘটানোর সাহস পাচ্ছে," বলেন মি. খান।

বস্তুত গত বছরের পাঁচই অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে পুলিশি ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। আবার একই সাথে মব তৈরি করে বিভিন্ন স্থানে একের পর এক হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটতে থাকে।

প্রথমদিকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা করা হলেও ক্রমেই সেটির ব্যাপ্তি বাড়তে থাকে।

'তৌহিদী জনতা' নাম দিয়ে বিভিন্ন মাজার ও দরগায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করতে দেখা যায়। সেই সঙ্গে, নারী তারকাদের শোরুম উদ্বোধন, নারী ফুটবলারদের খেলা বন্ধ করা ছাড়াও নাটক ও কনসার্ট আয়োজনের মতো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বাধা আসতে থাকে।

একইসাথে পিটিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। মানবাধিকার সংস্থা 'হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি'র হিসাবে, বাংলাদেশে গত সাত মাসে অন্তত ১১৯ জন ব্যক্তিকে বিভিন্ন অভিযোগে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

এমনকি, অর্ন্তবর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের ছয় মাসের মাথায়ও ঘোষণা দিয়ে ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরে অবস্থিত শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন ভাঙতে দেখা গেছে। একই সময়ে, দেশের অন্যান্য স্থানেও শেখ মুজিবের ম্যুরাল এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।


বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এসব মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা সামলাতে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব কর্মকাণ্ডে সরকারের সায় থাকার অভিযোগও রয়েছে।

"বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মব সৃষ্টিকারীদের আইনের আওতায় আনা যায়নি। কিছু কিছু ঘটনায় জড়িতদের কয়েকজনকে গ্রেফতার করার কথা শোনা গেলেও এখন পর্যন্ত কাউকে সেভাবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে দেখা যায়নি," বলেন মানবাধিকারকর্মী মি. খান।

এতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গেছে বলে মনে করেন অপরাধবিজ্ঞানীরা।

"দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে না পারার কারণে মব তৈরি করে হামলার মতো ঘটনা ঘটেই চলেছে। অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া না হলে এটা বন্ধ করা যাবে না," সাংবাদিকদের বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক এবিএম নাজমুস সাকিব।

মব তৈরির ক্ষেত্রে অনেক সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নানান প্রচার চালাতে দেখা যাচ্ছে।

সোমবারের হামলার আগে ফেসবুকে বেশ কিছু গ্রুপ এবং পেজে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলি পণ্য বয়কটের ডাক দিয়ে প্রচারণা চালাতে দেখা যায়।

ওইসব প্রচারণায় সাড়া দিয়ে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে 'অতি উৎসাহী' একটি অংশ কেএফসি, বাটাসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে থাকতে পারে বলে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।

"অনেক ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, একটি গোষ্ঠী সুপরিকল্পিতভাবে এ ধরনের ঘটনায় ইন্ধন বা উসকানি দিচ্ছে। ওইসব উসকানিদাতাকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা না গেলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে," বলেন মানবাধিকারকর্মী নূর খান।


কী প্রভাব পড়বে?

মব সৃষ্টি করে একের পর এক যে হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটছে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উভয়ক্ষেত্রে সেটার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

"এসব ঘটনার ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা বা উদ্বেগ তৈরি হতে পারে। অন্যদিকে, জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে সমাজে অপরাধ প্রবণতা আরও বেড়ে যেতে পারে," সাংবাদিকদের বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মি. সাকিব।

হামলার ঘটনার পর ব্যবসায়ীদের ইতিমধ্যেই নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সোমবার বিকেলের পর ঢাকাসহ অনেক স্থানে হামলার শিকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম সীমিত করতে দেখা যায়।

কোথাও কোথাও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের শাখা বন্ধও রাখতে দেখা যায়।

"পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কোম্পানি থেকে আজকের জন্য আমাদেরকে আউটলেট বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে," সোমবার সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের বলেন কেএফসি'র ঢাকা উত্তরা শাখার একজন কর্মকর্তা।


বিভিন্ন জেলায় হামলার ঘটনায় জুতা কোম্পানি বাটাও উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে।

"আমরা আমাদের দোকানে আক্রমণের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানাই। দেশের বিভিন্ন এলাকায় আমাদের অনেকগুলো দোকান ভাঙচুর করা হয়েছে ও মালামাল চুরি করা হয়েছে। একটি স্বনামধন্য বহুজাতিক কোম্পানির বিরুদ্ধে এই ধরনের আচরণ নিন্দনীয় ও দুর্ভাগ্যজনক," বিবৃতিতে বলেছে বাটা কর্তৃপক্ষ।

নিরাপত্তা শঙ্কায় মঙ্গলবার অনেক এলাকায় দেরিতে শোরুম খোলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাটার কর্মকর্তারা।

"গতকালের (সোমবারের) ঘটনার পর নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে কিছু কিছু এলাকায় একটু দেরিতে শোরুম খোলা হয়েছে। প্রশাসনের সহযোগিতা পাওয়ায় এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে,"সাংবাদিকদের বলছিলেন বাটা বাংলাদেশের একজন কর্মকর্তা।

কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারাবে।

"বিনিয়োগের জন্য দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকা গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশি তো বটেই, দেশি বিনিয়োগের জন্যও এগুলো নিশ্চিত করার দিকে সরকারের নজর দেওয়া প্রয়োজন," সাংবাদিকদের বলেন অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।


সর্বশেষ